নর্দান লাইটস : রাতের আকাশে আলোর মেলা

যতদুর মনে পড়ে, ছোটবেলায় অনেক তারা দেখেছি আকাশে। শুধুমাত্র লোডশেডিংয়ের সময়টাতে বারান্দায় যাওয়া হত। বারান্দায় গেলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা গোণা শুরু। কখনোই গুনতে পারতাম না ঠিকমত। ৭৭-৭৮ বলে গোণা শেষ করে দিতাম। সেই রাতের আকাশের সাথে এখনকার রাতের আকাশের বিরাট পার্থক্য। আগের মত এখন আর আকাশে এত এত তারা-নক্ষত্রের দেখা পাওয়া যায়না। শুধু রাতের আকাশ নয়, এখনকার সন্ধ্যার ‍আকাশেও বেশ তফাৎ খুঁজে পাই। খুব সম্ভবত ২০০১-২০০২ সালের কথা, শেষবারের মত সন্ধ্যার আকাশ টকটকে লাল হতে দেখেছিলাম। এখন আর শেষ বিকেলের আকাশটাও লালচে হয়না আগের মত। সবই বদলে গেছে। অবশ্য এই বদলে যাবার পেছনে রয়েছে অসংখ্য কারণ এবং পক্ষে-বিপক্ষে বৈজ্ঞানিক যুক্তি। মূল বিষয়ে চলে যাই…

রাতের বেলা পৃথিবীর আকাশ কালো হয়ে যাবে, একরাশ জ্বলজ্বলে তারা ও নক্ষত্রদের সেখানে জ্বলতে দেখা যাবে, এটাই তো স্বাভাবিক। হঠাৎ যদি সেই রাতের আকাশটা লাল, নীল, সবুজ, গোলাপী ও ভায়োলেট রঙে ভরে যায়, তাহলে কি ব্যাপারটা অদ্ভুত হবে না? অদ্ভুত হলেও সত্য যে, পৃথিবীর কিছু সংখ্যক দেশে রাতের বেলা এভাবেই কয়েকটি রঙে আকাশ ছেয়ে যায়। পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের মানুষদের কাছে এটা অতিসাধারণ একট‍া বিষয়।

নর্দান লাইটস (Northern Light)

মূলত হাই ল্যাটিচিউড বা উঁচু অক্ষাংশের দেশগুলোতে প্রায়ই রাতের বেলা আকাশের কিছু অংশে সবুজ রং ছড়িয়ে থাকে। সবুজের সাথে মাঝে মাঝে লাল, নীল, গোলাপী রঙেরও দেখা মিলে। আকাশে এই রঙের ছড়াছড়িকেই বলা হয় নর্দান লাইটস (Northern Lights)। তবে এর ম‍ূল নাম হচ্ছে অরোরা (Aurora), বাংলায় ‘সুমেরুজ্যোতি’। প্রাচীনকালে এই আলোকছটা নিয়ে বিভিন্ন কুসংস্কার প্রচলিত ছিলো। প্রাচীন মিথে আরোরা’র বেশ বৈচিত্রময় বর্ণনা পাওয়া যায়।

তবে বিজ্ঞানের মতে, বায়ুমণ্ডলের থার্মোস্ফিয়ারে থাকা অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন পরমাণুর সাথে ম্যাগনেটোস্ফিয়ার থেকে আসা চার্জিত কণিকাসমূহের ইলেকট্রন-প্রোটন এর সংঘর্ষের কারণেই তৈরী হয় অরোরা। এই সংঘর্ষের কারণে চার্জিত কণিকাসমূহের কাছ থেকে পরমাণু বা অণুসমূহ কিছু শক্তি লাভ করে, যা অভ্যন্তরীণ শক্তি হিসেবে জমা হতে থাকে। এসব অভ্যন্তরীণ শক্তি যখন আলোকশক্তি হিসেবে বিকরিত হয়, তখনই অরোরা দেখা যায়। এসব ইলেকট্রন সাধারণত পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র বরাবর পরিভ্রমণ করায় শুধুমাত্র প‍ৃথিবীর দুই মেরু অঞ্চল উত্তর ও দক্ষিণেই অরোরা দৃশ্যমান হয়।

শিরোনামে নর্দান ল‍াইটস লিখলেও বারবার কেনো অরোরা শব্দটা ব্যবহার করছি, সেটা আগে ক্লিয়ার করি। এখানে মূলত অরোরা শব্দটিকেই প্রাধান্য দেয়া উচিত। কারণ মূল বিষয়টাই হচ্ছে অরোরা। এই অরোরাকে উত্তরের লোকেরা নর্দান লাইটস বলে। আর দক্ষিণের লোকেরা বলে সাউদার্ন লাইটস। তবে উত্তরের চেয়ে দক্ষিণ মেরু থেকে অধিক স্পষ্টভাবে অরোরা দেখা যায় বিধায় নর্দান লাইটস নামটাই বেশি পরিচিতি পেয়েছে।

অরোরা aurora

পৃথিবীর সবখান থেকে নর্দান লাইটস দেখা যায় না। যেহেতু পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ড দুই মেরু বরাবর সবচেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল, তাই শুধুমাত্র মেরু অঞ্চল থেকেই নর্দান লাইটস বা অরোরা দেখা সম্ভব হয়।

নরওয়ে, সুইডেন, কানাডা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আইল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও গ্রীনল্যান্ড থেকে সন্ধ্যা এবং রাতের বেলায় সবচেয়ে বেশি অরোরা দেখা যায়। এছাড়া কানাডিয়ান সীমান্তের কাছাকাছি যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরসীমা ‍‌আলাস্কা থেকে বছরে কয়েকবার অরোরা দেখা যায়। প্রতি দশবছরে একবার করে ফ্লোরিডা এবং জাপানে অরোরার দেখা পাওয়া যায়।

তবে এখন পর্যন্ত অরোরা দেখার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা হচ্ছে  আলাস্কা, কানাডা, এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ার কিছু অঞ্চল। এসব জায়গা থেকে প্রায় নিয়মিতই অরোরা বা নর্দান লাইটস দেখা যায়। আমি অবশ্য অনেক আগে থেকেই আলাস্কা যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। রাতের বেলা আলাস্কার রঙ্গীন আকাশের নিচে রাত কাটানোর চেয়ে ভালো অনুভূতি আর কি হতে পারে ! ক্রিস্টোফার ম্যাকেন্ডলেসের মত…

Leave a Reply