বরফে মোড়ানো আকাশছোঁয়া ‘মানালি’ !

অনেক দিনের মনের স্বাদ বরফের পাহাড় দেখা ! প্রায় ১ বছর প্লান করার পর ২০১৫ ডিসেম্বরের ২৪ তারিখ যাত্রা করলাম আমি, মেহেদী, মাসফিক, আল আমিন, আশরাফ, সাকিব। পুরা ভারত জুড়ে রয়েছে হাজার হাজার দর্শনীয় স্থান। ১৮ দিনের এই ভ্রমনে কলকাতা, দিল্লী, আগ্রা, আজমীর, জয়পুর, সিমলা, মানালি।

একেক স্থানের রুপ একেক রকম। কিন্তু সবচেয়ে ভাল লাগার স্থানটা মানালি ! একদিকে যেমন আছে সাজানো পাহাড়, খরস্রোতা নদী, ঝর্না, বরফ, তেমনি আছে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু মোটরওয়ে। যা যোগ করবে আপনার ভ্রমণে রোমাঞ্চের পালক। আর বোনাস হিসাবে আছে দূরে হিমালয়ের হাতছানি।

বলা হয়ে থাকে, প্রাচীনকালে সপ্তর্ষি বা সপ্ত-ঋষির বাসস্থান ছিল এই মানালি। সুদূর অতীতে যার নাম ছিলো ‘মানালিসু’। ব্রাহ্মন বিধান কর্তা মনুর নাম থেকে এই শৈল শহরের নামকরণ। ‘মানালি’ শব্দটার আক্ষরিক অর্থ ‘মনুর বাসভূমি’।

Manali

আকাশছোঁয়া মানালি

ঈশ্বরের এক অপরূপ সৃষ্টি এটি। পাহাড়ের কোল ঘেষে দাড়িয়ে থাকা ঘর-বাড়িগুলো ছোট হলেও ছবির মতো। মানালি শহরে প্রবেশের পথে কথনো চোখে পড়বে ঘন জঙ্গল, কথনো বরফগলা নদী আবার কোথাও ঝর্না। মনে হবে যেন, দানবাকৃতির পাহাড় শ্বেত-শুভ্র কাপড় পরে মায়ের আদরে আগলে রেখেছে এ জনপদকে। গোটা মানালি বরফে ঢাকা পড়ে মূলত শীতের সময়। পূর্নিমার রাতে তখন অনন্য অপরুপা মানালি। বিপাশার পাড়ে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখলে চোখ সত্যিই জুড়িয়ে যাবে। কোন মূল্য গুনতে হবেনা মানালির এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে। ‘বিপাশা’ বহমান এ নদীর প্রাচীন নাম। বর্তমানে এটি ‘বিয়াস’ নদী নামে পরিচিত। এলাকার মানুষজন বলে, ব্রাহ্মন বিধান কর্তা মনু তাঁর নৌকা থেকে মানালিতে নেমেছিলেন মানুষকে নবজীবন দিতে। পরবর্তীতে তার নামানুসারে মানালির নামকরন হয়। ‘মানালি’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘মনুর বাসভূমি’। প্রবল বন্যায় পৃথিবী আক্রান্ত হবার পরে মানালি ‘দেব উপত্যকা’ নামে পরিচিত। পুরনো মানালি গ্রামে ঋষি মনুর নামে একটি প্রাচীন মন্দিরও আছে।

কখন যাবেন মানালি ?

মার্চ-জুন থাকে সামার। এই সময় মানালির তাপমাত্র ঘুরফির করে ১০-২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে। আর এই সময়টাই বেস্ট মানালি দেখার জন্য। জুলাই-সেপ্টেম্বর বর্ষাকাল। পাহাড়ি এলাকায় এই সময় বেড়াতে না যাওয়াই ভালো। নির্মল সবুজের সমারহ থাকলেও, ঝুঁকির পাল্লাটাই ভারি থাকে বর্ষায়। আর অক্টোবর- ফেব্রুয়ারি শীতকাল। তুষার স্নাত থাকে মানালি। সাধারণত যা ডিসেম্বরে হতো, গত ১৫ বছর ধরে তা পিছিয়ে জানুয়ারী বা ফেব্রুয়ারীর শুরুতে হচ্ছে। কেউ শুধুই স্নো-ফল দেখতে চাইলে তাদের জন্য এটা সেরা সময় হবে। তবে, এসময় অনেক পাহাড়ি রাস্তা বন্ধ থাকার সম্ভবনা বেশি থাকে। তাই জেনেশুনে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের মত কাজ হবে।

মানালি যাতায়াত ব্যবস্থা

মানালির পথের সবচে বড় চ্যালেঞ্জ হল ভারতের ভিসা পাওয়া। পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়া সত্ত্বেও বিনা ভিসায় ভারত ভ্রমণ করা যায় না। হাতে অনেক সময় থাকলে আর খরচ কম করতে চাইলে বাই রোডে কোলকাতা যান। কোলকাতা থেকে ট্রেনে প্রায় ১৮/১৯ ঘন্টার জার্নি করে পৌছে যান ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লীতে। দিল্লী থেকে বাই রোডে শিমলা হয়ে মানালি যেতে পারবেন। এতে আপনার শিমলাটা ঘুরাও হয়ে যাবে। অনেকে কোলকাতা থেকে চান্ডিগাড় হয়েও মানালি যান। দিল্লি থেকে মানালি সড়ক পথে অন্তত ১৪ ঘণ্টার পথ। ভলভো এসি বাসে প্রতিজনে যাওয়া-আসার ভাড়া পড়বে প্রায় ২৫০০ রুপি। রুট চয়েস আপনার নিজের হাতে। আর যাদের খরচ নিয়ে চিন্তা নেই, কিন্তু হাতে সময় একেবারেই কম তারা মানালি অনেক দূরে বলে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। তারাও মানালির অপরূপ সৌন্দর্য চাইলেই দেখতে পারেন, যাওয়ার মাধ্যম যদি হয় বিমান। তবে, মানালি শহর থেকে ৫০ কি.মি দূরে ভুনটার বিমানবন্দর। এখানেও চিন্তার কিছু নেই, বিমানবন্দরে নেমে ট্যাক্সি ভাড়া করে শহরে চলে আসুন। হোটেল বুকিংটা আগেই করুন। এতে আপনারই সুবিধা হবে।

মানালিতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা

মানালিতে থাকা-খাওয়া আর ঘুরে বেড়ানোর খরচ খুব বেশি নয়। এখানে থাকা-খাওয়ার জন্য বিভিন্ন মানের হোটেল রয়েছে। মানালি শহরের আশপাশে রয়েছে অনেকগুলো আপেলের বাগান, ঘন দেবদারু বন, পাহাড়ি নদী-ঝরনাসহ ছোটখাটো অনেকগুলো ট্যুরিস্ট স্পট। মানালি গিয়ে সুস্বাদু ট্রাউট মাছ ভাজা না খেয়ে আসাটা ঠিক হবে না। আপনি ইন্ডিয়ান, সাউথ ইন্ডিয়ান খাবার অথবা ফাস্টফুড আইটেম খেতে পারেন। ৫০০- ৩০০০ রুপির মধ্যে মোটামুটি মানের হোটেল পেয়ে যাবেন। আর কেউ যদি মানালিতে ফাইভ স্টার রিসোর্টগুলোতে থাকতে চান তাহলেও পেয়ে যাবেন।

কি কি দেখবেন?

সবুজের সমারোহে এ পাহাড়ি পথের ৫০ কি.মি শুধুই গভীর জঙ্গলে ঢাকা। এ পথে ছায়াঘন প্রকৃতির রূপের মধ্য দিয়েই যেতে যেতে দেখে নেয়া যায় ৪৭০ কিমি দীর্ঘ বিয়াস নদী। এখানে দেখা মিলবে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা হিমালয়ের বিভিন্ন শৃঙ্গের চূড়াগুলো। মানালি শহরের চারপাশ সাজানো চকচকে দোকানপাট, শুপিংমল, হোটেল, রেস্তোরাঁ দিয়ে। হেঁটে ঘুরে নিতে পারবেন মানালির মাল রোড(মার্কেট প্লেস)। বেশ জমজমাট, সবসময় লোকসমাগম হয় এখানে। মার্কেটের পেছন দিকে তিব্বত মনাস্ট্রি। ঘুরে দেখতে পারেন মানালির মন্দির গুলো। তার মধ্যে বশিষ্ট মুনির মন্দির, রাম মন্দির, হিড়িম্বা মন্দির, মনু মন্দির, বিজলি মহাদেব মন্দির উল্লেখযোগ্য।

মহাভারতে কথিত আছে, হিড়িম্বাকে এখানে এই জঙ্গলের মধ্যে বিয়ে করেন পান্ডব রাজপুত্র ভীম। তাই ভীমের পত্নী হিড়িম্বা রাক্ষসী হলেও মানালিতে তিনি দেবী। প্রতিটি মন্দিরেরই আছে আলাদা আলাদা গল্প। কিছুটা হেঁটে দেখতে পাবেন আপ্পুঘর ও হিমাচল ফোক মিউজিয়াম। হিমাচল সংস্কৃতির নানা জিনিস রাখা আছে এখানে। মানালসু নদী পার হয়ে ওল্ড মানালির গ্রাম থেকে ৩ কি.মি দূরে দেখা মিলবে বশিষ্ট মুনির মন্দিরের।

রোটাং পাস

মানালির প্রধান আকর্ষন বরফ। আর বরফের প্রধান আকর্ষণ নিতে অবশ্যই যাবেন বরফের স্বর্গরাজ্য রোটাং পাসে (Rohtang Pass)। রোটাং পাস সাধারণত খোলা থাকে মে-অক্টোবর। এই সময়ের মধ্যেও কোন কোন দিন এটি বন্ধ থাকে। তাই রোটাং পাস দেখতে চাইলে সব খোঁজ খবর নিয়ে যাওয়াটা উত্তম। মানালি থেকে বিয়াস নদী পেরিয়ে পাহাড়ের গায়ে পাক খেয়ে ৫১ কি.মি দূরে রোটাং পাস যাওয়া যায়। যতই উপরে উঠবেন, ততই চোখে পড়বে তুষারশৃঙ্গ। এখানে ঠাণ্ডার প্রচুর দাপট। চারপাশে শুধু বরফ আর বরফ।

ফেসবুকে ছারপোকা ম্যাগাজিনের সাথে যুক্ত থাকুন। লাইক করুন Charpoka অফিসিয়াল পেজে !

আরো পড়ুনঃ

Leave a Reply