Le Samourai : একজন হিটম্যানের গল্প

হালকা আলোয় ঘেরা এক রুম। মাঝখানে একটা খাট। খাটে শুয়ে এক লোক আরামসে সিগারেট ফুঁকছে। তার চেহারা ঠিকমত দেখা যাচ্ছে না। খাটের ঠিক পাশেই একটি পাখির খাঁচা। বদ্ধ খাঁচার ভেতর থেকে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। রুমের এক পাশে আছে দুটো জানালা। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। পুরো রুমে জুরে বৃষ্টির শোঁ শোঁ শব্দ। খানিকবাদেই শোনা যায় রহস্যময় এক ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। এবং তার পরেই স্ক্রিনে নিচের লেখাটি ভেসে উঠে –

“There is no greater solitude than that of the samurai unless it is that of the tiger
In the jungle…
Perhaps…” — Bushido (Book of the Samurai)

খাটে শুয়ে সিগারেট ফুঁকছে জেফ কস্টেলো

এটা ছিল সিনেমার একদম শুরুর দৃশ্য । সিনেমার শুরুটা এরকম রহস্যজনক ভাবে হলে স্বাভাবিক ভাবেই সিনেমার প্রতি আগ্রহ বেরে যায় ।

এটি ১৯৬৭ সালে পরিচালক Jean-Pierre Melville পরিচালিত ফরাসি ভাষার সিনেমা “ Le Samourai ” । সিনেমাটি একটি চমৎকার ক্রাইম-থ্রিলার সিনেমা । এবং একটি মাস্টওয়াচ সিনেমা ।

এবার সিনেমার কাহিনী সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেয়া যাক । সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছে জেফ কস্টেলো নামের ৩০ বছরের এক যুবক । পেশায় সে একজন হিটম্যান । মানে টাকার বিনিময়ে মানুষ হত্যা করাই তার কাজ । একজন হিটম্যান যেমন সমাজের আট-দশটা মানুষের মতোই সাধারনভাবে চলাফেরা করে । জেফ কস্টেলোও সেরকম সাধারন মানুষের মতোই থাকে । সে প্যারিসের একটা ভাড়া বাসায় থাকে । জেফ তার কাজকর্মে পারদর্শী । নিখুঁতভাবে সে তার কাজকর্ম করে । সব সময় ঘড়ি দেখে চলে সে । ঘড়ির কাঁটার হের-ফের করে না সে । খুব কম কথা বলে । একদম শীতল হৃদয়ের অধিকারী । সবসময় মাথায় হ্যাট আর ট্রেঞ্চকোট পড়ে বেরোয় । সাথে থাকে বিশাল এক চাবির গোছা । যেন তার চাবির গোছায় জগতের যেকোন তালার চাবিই আছে ।

জেফ কস্টেলোর চাবির গোছা

জেফ একটা নতুন এসাইনমেন্ট পায় । একটা নাইট ক্লাবের মালিককে খুন করতে হবে । অন্যসব এসাইনমেন্টের মতো এবারো জেফ সকল প্রস্তুতি নিয়ে নেয় । মাথায় হ্যাট আর ট্রেঞ্চকোট পড়ে বের হয় । সাথে নিয়ে নেয় তার সেই বিশাল চাবির গোছা । কিন্তু এবারের এসাইনমেন্টটাই জেফের জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াল ! নাইট ক্লাবের মালিককে খুন করে বের হয়ে যাওয়ার সময় সেই ক্লাবের একজন পিয়ানোবাদক মেয়ে তাকে একদম কাছ থেকে দেখে ফেলে । এছাড়াও ক্লাবের বারটেন্ডার সহ আরো কয়েকজন খুন করে ক্লাব থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় জেফকে দেখে ফেলে । এরপর পুলিশ আসে । প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা শুনে পুলিশ জেফকে সন্দেহ করে । এবং সন্দেহভাজন হিসেবে তাকে আটক করে পুলিশ । কিন্তু উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায় জেফ কস্টেলো । ছাড়া পেয়ে গেলেও পুলিশের চোখে সে একটা খুনের প্রাইম সাসপেক্ট । পুলিশ এতো সহজে জেফকে ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয় । জেফের পিছনে পুলিশ আঠার মতো লেগে রইলো । তার প্রতিটা পদক্ষেপে নজর রাখা শুরু করলো পুলিশ । যেকারনে জেফ কস্টেলোকে পালিয়ে বেড়াতে হলো ।

মাথায় হ্যাট আর ট্রেঞ্চ কোটে জেফ কস্টেলো

জেফ কস্টেলো কি পারবে পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে ?? নাকি সে ধরা পড়ে যাবে??? জেফের শেষ পরিণতি কি হবে ?? জানতে হলে আপনাকে সিনেমাটি দেখতে হবে । সিনেমার শেষটুকু নিয়ে অনেকের অনেক মতামত আছে । তবে আমার কাছে একদম অর্থবহ লেগেছে শেষটুকু ।

সিনেমায় ডায়লগ খুবই কম ব্যাবহার করা হয়েছে । বাড়তি ডায়লগ ব্যাবহার করা হয় নই । কিন্তু যতটুকু ডায়লগ ছিল সিনেমায় তা একদম পারফেক্ট । সিনেমার প্রথম ১০ মিনিটে কোন প্রকার ডায়লগ নেই । দেখার পর তো ভেবেছিলাম এটা কোন সংলাপবিহীন সাইলেন্ট মুভি । কিন্তু ভুলটা ভাঙে কিছুক্ষন পরেই । সিনেমায় কোন অপ্রোজনীয় দৃশ্য ছিল না । সিনেমার সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে স্টোরি । অসাধারন স্টোরি টেলিং এবং অসাধারন প্রেজেন্টেশন । সিনেমা দেখার সময় একটুর জন্যেও বোরিং ফিল করিনি । সিনেমায় একজন হিটম্যানের ধরা বাধা জীবন-যাপন এবং তার কাজের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে । এ দিক থেকে পরিচালক Jean-Pierre Melville দারুন মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন ।

খুনের দৃশ্যে জেগ কস্টেলো

অভিনয়ের কথা বললে হিটম্যান জেফ কস্টেলোর চরিত্রে অভিনয় করা Alain Delon এর যত সুনাম করা হবে ততই যেন কম হয়ে যাবে । একদম পারফেক্ট হিটম্যানের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি । একজন স্মার্ট- ইয়ং হিটম্যান , একজন মিতভাষী , একজন শীতল হৃদয়ের অধিকারী যার মধ্যে নেই কোন অস্থিরতা । যে সবসময় সময়ের সাথে চলে । যার একমাত্র কাজই হচ্ছে মানুষ খুন করা । এই কাজটাই তার জীবিকা মেটায় । এক কথায় মাইন্ডব্লোয়িং পারফরমেন্স । এরকম অসাধারন প্রেজেন্টেশন সহজে ভোলার মত নয় । এছাড়াও বাকি চরিত্র গুলোর অভিনয়ও ছিল যথেষ্ট ভাল ।

১ ঘন্টা ৪৫ মিনিটের সিনেমায় পরিচালক Jean-Pierre Melville তার সুনিপুণ হাতে ক্যামেরার কারসাজী দেখিয়েছেন । সিনেমার একদম শুরুটাই ক্যামেরার একটা লম্বা শট দিয়ে শুরু করেছেন । সিনেমাতে তিনি অপ্রয়োজনীয় কিছুই ব্যাবহার করেন নি । না ডায়লগ , না দৃশ্য । পুরো সিনেমাতেই পরিচালক একটা উত্তেজনাকর আবহাওয়া রেখেছেন । সাথে ছিল অসাধারন কিছু রহস্যময় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক । সিনেমার একটা পর্যায়ে এসে জেফ কস্টেলোর প্রতি দর্শকদের ভালোবাসার সৃষ্টি হয় । সিনেমার একদম শেষ পর্যন্ত দর্শকদের চাওয়া ছিল জেফ যেন পুলিশের হাতে ধরা না পড়ে । দর্শকদের মনে জেফ কস্টেলোর প্রতি এরূপ ভালবাসার সৃষ্টি হওয়া। পরিচালক এক্ষেত্রে পুরোপুরি সফল হয়েছেন। হিটম্যান নিয়ে একদম নিখুঁত ক্রাইম-থ্রিলার সিনেমা বানিয়েছেন ।

Le Samourai (1967)

Poster: Le Samourai (1967)

পরিশেষে সিনেমা নিয়ে একটি কথাই বলবো , হিটম্যান নিয়ে এ পর্যন্ত যত গুলো সিনেমা নির্মিত হয়েছে নিঃসন্দেহে Le Samourai তার মধ্যে সবথেকে সেরা সিনেমা । ইট’স দ্যা বেস্ট ফিল্ম এভার মেড এবাউট হিটম্যান । যদি কখনো প্রিয় ক্রাইম-থ্রিলার সিনেমার লিস্ট করি তাহলে এই সিনেমার জায়গা লিস্টের প্রথম দিকেই থাকবে ।

আইএমডিবিতে সার্চ করে এই সিনেমার কয়েকটি ট্যাগ লাইন দেখলাম । নিচে তিনটি ট্যাগ লাইন দিলাম যা এই সিনেমায় জেফ কস্টেলোর চরিত্রের সাথে একদম মানানসই :

  1. Things suddenly go badly for a successful French assassin
  2. Paris was cold and wet… a killer waited in the shadows
  3. His only friend was his gun!

সিনেমা দেখে রেটিং করাটা আমার পছন্দের না । আর রেটিং দেখে সিনেমা দেখারও অভ্যাস নেই । তবে যদি এই সিনেমার রেটিং করতে হয় তবে আমি এক চান্সেই এই সিনেমাকে ১০/১০ দিব । সবাইকে এই সিনেমা দেখার জন্যে হাইলি রেকমেন্ড করলাম….

Leave a Reply