মধ্যাহ্ন | হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদের মধ্যাহ্ন মূলত দেশভাগ নিয়ে একটি লেখা ! এখানে লেখক তুলে ধরেছেন ক্ষমতাশীলদের জোরপূর্বক শাসন-শোষণ অত্যাচার, গ্রামীন কুসংস্কার,সরলতা ইত্যাদি বিষয়গুলো।

এককালের অতি প্রতাপশালী জমিদার শশাঙ্ক পালের মৃত্যু হলো ১২ই চৈত্র ১৩৪৭ সনে। ইংরেজি ২৩ মার্চ ১৯৪০ সন। বিশেষ একটা দিন। ওই দিন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ‘লাহোর প্রস্তাব’ ঘোষণা করেন। লাহোর প্রস্তাবে উত্তর পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব ওঠে। লাহোর অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন মোহম্মদ আলী জিন্নাহ। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ তখন পুরোদমে চলছে। জার্মান আর্মি গ্রুপ সি বেলজিয়ামের ভেতর দিয়ে ঢুঁকে পড়ে নেদারল্যান্ড আক্রমণ করেছে। অতি অল্প সময়ের তারা ফ্রান্সের মধ্যে ঢুকে যায়। দুর্ভেদ্য মজিনো লাইন কোনো কাজেই আসে না। লন্ডনে চলতে থাকে টানা বিমান আক্রমণ। ব্রিটিশ সিংহাসন থমকে দাঁড়ায়। কারণ বোমা পড়ছে বাকিংহাম প্রাসাদে। যেখানে বাস করেন রানী এলিজাবেথ। রানীকে প্রাসাদ থেকে গোপন আবাসে সরিয়ে নেওয়া হলো। কেউ জানেনা কোথায় রানী !

মধ্যাহ্ন বইয়ের উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ

ইমাম করিম খেতে বসেছেন। তাকে খাবার দেওয়া হয়েছে উঠানে। দরজার পাশে। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শরিফা তদারকি করছে। ইমাম সাহেব ডাকলেন, শরিফা?

শরিফা হাতের পাখা দিয়ে দরজায় বাড়ি দিল। এর অর্থ সে শুনছে। পর পুরুষের সঙ্গে কথা বলা নিষিদ্ধ। তবে আকারে ইঙ্গতে প্রশ্নের জবাব দেওয়া যায়। এতে দোষ হয় না।

করিম বললেন, আজ তোমার হিল্লা বিবাহের কথা প্রকাশ্যে বলেছি। মনে হয় দ্রুত ব্যবস্থা হবে। এরপর আগের মত সংসার করতে পারব। তোমার জন্য সারাক্ষণ আমার মন কান্দে। তোমারে যে এতটা পছন্দ করতাম আগে বুঝি নাই। আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই। তুমি কি আমাকে ক্ষমা করেছ? ক্ষমা করলে পাখা দিয়া দুইটা বাড়ি দেও।
শরিফা দুইটা বাড়ি না, সে ঠুক ঠুক করে ক্রমাগত বাড়ি দিয়েই যেতে লাগল। এর অর্থ কী করিম বুঝতে পারছে না। শরিফাকে দেখতে পেলে করিমের ভাল লাগত। শরিফার চোখ দিয়ে টপ টপ পানি পড়ছে।

করিম বললেন, কী বলতে চাও বুঝি না তো। মুখে কথা বলো। অসুবিধা নাই। শরিফা চাপা গলায় বলল, আমি হিল্লা বিবাহ করব না।

– চাও কী তুমি?
– আপনারে নিয়ে দূর দেশে পালায়া যাব। যেখানে আমারে কেউ চিনব না। আমি যে আপনার তালাকি বউ কেউ জানব না।
– কোন দূর দেশে যাইতে চাও?
– আসাম

করিম ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আসামে গেলে কেউ জানবে না তা ঠিক আছে। কিন্তু আল্লাহপাক তো জানবেন। নাকি তোমার ধারণা উনিও জানবেন না? শরিফা চুপ করে গেল। করিম অনেক রাত পর্যন্ত তার ফোঁপানো শুনল।

ধনু শেখ শরিফাকে বিবাহ করে স্ত্রী নিয়ে ঘরে ফিরেছেন। শরিফা জড়সড় হয়ে আছে। অকারণে চমকে চমকে উঠেছে। আতর তার সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করছে। চিরুনি নিয়ে চুল আঁচড়ে দিয়েছে। সহজ স্বাভাবিক গলায় বলেছে, কলিকাতা থেকে কলের গান আনায়েছি। আপনি কি গান শুনবেন? জুলেখার একটা থাল আছে। একপিঠে উনার গান, অন্যপিঠে কৃষ্ণভানুর গান।

শরিফা ক্ষিণ গলায় বললো, গান শুনব না।
আতর বললো, কাঁপতেছেন কেন?
শরিফা বললো, ভয়ে কাপতেছি। খুব ভয় লাগতেছে আতর।
আতর সহজ গলায় বললো, মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছেন, একজীবনে অনেকবার ভয় পাবেন। মেয়ে হয়ে জন্মানোর এটাই শাস্তি।

ধনু শেখ প্রচুর মদ্যপান করে এক রাতের স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমাতে গেলেন। জড়ান গলায় বললেন, বৌ শরিফা, তুমি বড়ই ভাগ্যবতী। ঠ্যাংওয়ালা স্বামীর সঙ্গে সংসার করলা, আবার ঠ্যাং ছাড়া স্বামীর সাথেও সংসার করলা। হা হা হা।
শরিফা আতঙ্কে এবং ভয়ে শিউরে উঠল।

ফজরের নামাজ পড়েই করিম ধনু শেখের বাড়ি চলে এসেছে। ধনু শেখ ঘুম থেকে উঠলেন দুপুরবেলায়। করিমকে বাংলাঘরে ডেকে পাঠালেন। দরাজ গলায় বললেন, প্রচুর মদ্যপান করে রাতে শুয়েছি। শুয়েই ঘুম। স্ত্রীর সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা, আদর-সোহাগ কিছুই হয় নাই। কাজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ আর তালাক দিব না। তালাক ফালাক যা হবার কিছুদিন পরে হবে।

করিম বলল, এসব কী বলেন?
ধনু শেখ গলা উঁচিয়ে বললেন, কী বলি মানে? তোমার সঙ্গে কি দলিল করিয়েছি যে একদিন পরে স্ত্রী তালাক দেব? বলো কোন দলিল করেছি?
করিম হতভম্ব গলায় বলল, আমি শরিফার সঙ্গে কথা বলব।
ধনু শেখ বললেন, অন্যের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাও, এটা কেমন কথা? পর্দাপুষিদা বিস্মরণ হয়েছে? যাও বিদায় হও। অনেক ত্যাক্ত করেছ, আর না!

এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন কতটা চমকপ্রদ এই মধ্যাহ্ন বইট? তাহলে আর দেরী না করে পড়ে ফেলুন। আমি হয়ত অতটা গুছিয়ে লিখতে পারিনি ! তবুও চেষ্টা করেছি। বাকিটুকু নিজ দ্বায়িত্বে পড়ে নিবেন। পৃথিবী বইয়ের হোক। হাটে, ঘাটে, মাঠে, শহর, নগর, বন্দরে ছড়িয়ে পড়ুক বইয়ের গল্প !

হ্যাপি রিডিং !

লেখক সম্পর্কে কিছু কথা…

হুমায়ূন আহমেদ, তিনি বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে গণ্য করা হয় তাঁকে। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার এবং গীতিকার। বলা হয় আধুনিক বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের তিনি পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবেও তিনি বেশ সমাদৃত। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তিন শতাধিক। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীর জনক। তার বেশকিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বেশকিছু গ্রন্থ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। তার সৃষ্ট হিমু এবং মিসির আলি ও শুভ্র চরিত্রগুলি বাংলাদেশের যুবশ্রেণিকে গভীরভাবে উদ্বেলিত করেছে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীও তাঁর সৃষ্টিকর্মের অন্তর্গত। ধরা হয় বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর জনপ্রিয়তা তিনি শুরু করেন। তাঁর রচিত প্রথম সায়েন্স ফিকশন “তোমাদের জন্য ভালোবাসা”। তাঁর নির্মিত খুব পছন্দ করতেন।সব চেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে! তিনি তার প্রথম সৃষ্টি কর্ম “নন্দিত নরকে” দিয়েই পাঠক সমাজের হৃদয়ে অবস্থান গ্রহণ কতে সম্মত হয়!

বাস্তব জীবনে তিনি ছিলেন ভণিতাবিহীন অত্যন্ত সহজ-সাধারন ও প্রকৃতি প্রেমী।

Leave a Reply