মহাকাশে যা ঘটেছিলো লাইকা’র সাথে

ইতিহাসের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ কুকুর হিসেবে পরিচিত লাইকা ! মায়াবী চেহারার একটি প্রাণী। মানুষই তাকে মহাকাশে পাঠ‍ানোর গৌরব দিয়েছে। আবার এই মানুষের দেয়া গৌরব অর্জন করতে গিয়েই ১৬২ দিনের ভয়ানক একাকীত্বকে বরণ করে চলে যেতে হয়েছে কুকুরটিকে। হাত পা নাড়তে না পারা একটা খুপড়ির ভেতর ১৬২ দিন একা কেমন লাগবে আপনার? তাও সেটা যদি পৃথিবী না হয়ে হয় মহাকাশ ! ভয়ানক একাকীত্ববোধ আর দুশ্চিন্তা নিয়ে আপনি মারা যাবেন মাত্র সাত দিনেই !

পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম মহাকাশচারী হিসেবে যে প্রাণীটির নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, তা হল একটি কুকুর। যার নাম লাইকা ! ছোটবেলায় সাধারণ জ্ঞান বইতে আমরা পড়েছি, লাইকা নামের সেই কুকুরটি ছিল সফলভাবে মহাকাশ ভ্রমণ এবং পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরে আসা প্রথম প্রাণী। কিন্তু আমাদের অনেকেরই এটা অজানা যে লাইকা মহাকাশে যাওয়ার আগে আরো কয়েকটি প্রাণীকে মহাকাশে পাঠানোর চেষ্টা করা হয় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলতাও পাওয়া যায়…

তবে সত্যটা হচ্ছে, মহাকাশে প্রথম প্রাণী হিসেবে কুকুর যায়নি !

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, স্পেসে প্রথম যাত্রা সূচনা করা প্রাণীটি হচ্ছে মাছি ! 1947 সালে দ্য ভি টু (The V2) রকেটে করে কিছু মাছিকে পাঠানো হয় মহাকাশে। প্রাণীদের উপর মহাকাশের আলোর বিকিরণের প্রভাব পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল এই ক্ষুদ্র প্রাণীগুলোকে।

দ্বিতীয়বার মহাকাশে পাঠানো প্রাণীটি হল ইঁদুর। 1950 সালের 31 আগস্ট আমেরিকান রকেটে করে এই প্রাণীকে পাঠানো হয় স্পেসে। তবে দুর্ভাগ্যবশত প্যারাসুট সিস্টেমে সমস্যা হওয়ায় বেচারা ইঁদুরগুলোকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

এছাড়াও লাইকা বাদে আরো ছত্রিশটি কুকুরকেও মহাকাশ অভিযানে পাঠানো হয়েছিলো। কিন্তু লাইকা প্রথম কুকুর যে পৃথিবীর কক্ষপথে ভ্রমণ করে এবং পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। তাই লাইকাকে বলা হয় মহাকাশ পরিভ্রমনকারী প্রথম প্রাণী।

এবার আসা যাক লাইকার মহাকাশ ভ্রমণের গল্পে…

লাইকা

স্পেসশিপে লাইকা

সময়টা 1957 সাল। তখন রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-1 উৎক্ষেপণের কিছুদিন পরই রাশিয়া দ্বিতীয় মিশন হিসেবে স্পুটনিক-2 উৎক্ষেপনের পরিকল্পনা করে। এবং এবার তারা পৃথিবীর মানুষকে চমকে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এবং নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য জীবিত কোন প্রাণীকে মহাকাশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তটি এত দ্রুত নেওয়া হয় যে রাশিয়ার রকেট ইঞ্জিনিয়ারদের হাতে সময় ছিল মাত্র চার সপ্তাহ। ওই সময়ের মধ্যে তাদের উপর মহাকাশে প্রথম জীবন্ত প্রাণী পাঠানো রকেট স্পুটনিক-2 তৈরীর ভার চাপে। ফলে তাড়াহুড়োতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাও অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই মহাকাশযানটির নকশা বিশেষভাবে একটি কুকুরের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। যেটাতে একটা অক্সিজেন জেনারেটর, এয়ারকুলার, কিছু খাবারদাবার এবং কুকুরের মলমূত্র সঞ্চয়ী কেবিনেটের ব্যবস্থা ছিল। কুকুরের থাকার কেবিনটি এমনভাবে বানানো হয়, যেখানে সে পাশ ফিরতেও পারবে না। এভাবেই স্পুটনিক-2 এর কাজ দ্রতগতিতে চলতে থাকে।

এবার তারা মহাকাশে গমনের উপযুক্ত কুকুরের খোঁজ শুরু করে। বিজ্ঞানীরা এই গবেষণায় রাস্তার কুকুরকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। কারণ এদের মধ্যে রয়েছে তীব্র কষ্ট, গরম এবং ক্ষিদে সহ্য করার ক্ষমতা। মরোক্কোর রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরতে থাকা লাইকাকেই বিজ্ঞানীরা বেছে নেয় মহাকাশচারী হিসেবে। লাইকাকে বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে বলা যায়, লাইকা ছিল আকারে ছোট, শান্ত এবং আকর্ষণীয়।

ধরে আনার পর লাইকার ট্রেনিং শুরু হয়ে যায়। যেহেতু স্পুটনিক-2 এর কেবিনটি খুব ছোট ছিল তাই লাইকাকেও বিশ দিনের জন্য একটা ছোট খাঁচাতে রেখে দেওয়া হয় যেনো সে এরকম পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে নিতে পারে। এই ঘটনাক্রমগুলো প্রতিটি মানুষের জন্য খুবই আনন্দদায়ক ছিল। কিন্তু তখনো পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা মহাকাশে শুধুমাত্র মহাকাশযান পাঠাতে পারতেন। কিন্তু মহাকাশযানকে পুনরায় ফিরিয়ে আনার কৌশল তখনো বিজ্ঞানীদের জানা ছিল না। অর্থাৎ, লাইকাকে মহাকাশে পাঠানোটা সম্ভব হতে পারে কিন্তু তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। নিজের এই অদূর ভবিষ্যত্ সম্পর্কে অজ্ঞ লাইকাকে এক বিজ্ঞানী ট্রেনিং শেষে তার বাড়িতে নিয়ে যায় এবং তাকে শেষবারের মত তার ছেলেমেয়েদের সাথে খেলার সুযোগ করে দেয়।

অভিযানের দিন ঘনিয়ে আসতে থাকে। এরপর লাইকাকে তার মহাকাশযানের ছোট কেবিনটার ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কেবিনের ভিতর লাইকা যাতে দাঁড়াতে না পারে বা নড়াচড়া করতে না পারে সেজন্য তাকে একটা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। এ অবস্থায় লাইকাকে খাদ্যদ্রব্য সহ তিনদিন রেখে দেওয়া হয়। যাতে করে সে মহাকাশযানটির সাথে পরিচিত হয়ে উঠতে পারে।

১৩ নভেম্বর, ১৯৫৭

স্পুটনিক-২ তখন ওড়ার জন্য প্রস্তুত। তখন এক টেকনিশিয়ান লাইকাকে শেষবারের মত তার কেবিনে ঢুকিয়ে দেওয়ার আগে তার নাকে চুমু খায় এবং তার জন্য নিরাপদ যাত্রা কামনা করে এটা জেনেও যে সে আর কখনো ফিরবে না!

কিছুক্ষণ পরেই স্পুটনিক-২ লাইকাকে নিয়ে মহাকাশের দিকে তীব্রগতিতে পাড়ি দেয়। কিন্তু যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে স্পুটনিক-২ এর একটা অংশ স্পুটনিক-২ হতে আলাদা হতে পারেনা। কারণ চার সপ্তাহে একটি স্পেসক্র্যাফটের কাজ সম্পূর্ণভাবে সম্পন্ন করা যায়নি। এর ফলে লাইকার কেবিনের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। এসময় লাইকার হার্টবিট ১০৩ থেকে বেড়ে ২৪০ হয়ে যায়। এর থেকে সহজেই বুঝা যায় আগুনে ঝলসাতে থাকা সেই স্পেসক্র্যাফটে লাইকা তখন কতটা ভীত এবং আতঙ্কিত ছিল আর কিভাবেই বা সে ওই প্রচণ্ড তাপমাত্রা সহ্য করছিলো…

প্রায় তিনঘন্টা ধরে লাইকা এই যন্ত্রণা সহ্য করেছিলো। ঠিক পাঁচঘন্টা পরেই লাইকার গায়ে লাগানো সেন্সর থেকে সিগন্যাল আসা বন্ধ হয়ে যায়। আর এভাবেই মহাকাশচারী লাইকা মহাকাশেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

লাইকার মৃত্যুর পর ১৬২ দিন যাবৎ স্পুটনিক-২ মহাকাশে ঘুরতে থাকে এবং প্রায় দুই হাজার পাঁচশো সত্তরবার পৃথিবীকে প্রদক্ষীণ করে।

১৪ এপ্রিল, ১৯৫৮

এইদিন স্পুটনিক-২ পৃথিবীর পরিমন্ডলে প্রবেশ করে। আর বায়ূমন্ডলের সাথে সংঘর্ষে ভূ-পৃষ্ঠে পৌঁছানোর আগেই লাকার মৃতদেহ নিয়ে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

২০০৮ সালে রাশিয়ার আধিকারিকরা লাইকার স্মরণে একটি স্মারক মূর্তি স্থাপন করেন। স্মারকটি সেইখানে স্থাপন করা হয় যেখানে লাইকাকে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিলো।

লাইকার এই উৎসর্গ যেমন বিজ্ঞানীদের মুখে হাসি ফুটিয়েছিল তেমনি পশুপ্রেমীদের চোখেও জল এনেছিল। লাইকার এই উৎসর্গের মাধ্যমে মহাকাশযাত্রা একলাফে অনেকটা দূর এগিয়ে যায়। বর্তমানে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড যে টাকা ব্যায় করে একটি ফুটবল টীম তৈরি করে সে টাকায় আমাদের ভারতবর্ষ মঙ্গল থেকে ঘুরে আসে। কাজেই মহাকাশযাত্রাকে এতটা সহজ করে তোলার পেছনে একটি কুকুরের ভূমিকা কতটা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, মহাকাশযাত্রার এ ঘটনা মানবজাতির জন্য গর্বের বিষয় হলেও লাইকার জন্য তা ছিল নিছকই দুর্ভাগ্য !

আরো পড়ুনঃ

Leave a Reply