ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশের সবচেয়ে বড় শহরের নাম বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই)। এই বোম্বে শহরের ছোট্ট একটা এলাকার নাম প্রতীক্ষা নগর। মূলত নিন্মবিত্ত আর নিন্মমধ্যবিত্ত মানুষের বসবাস এই এলাকায়। এরকমই এক নিন্মমধ্যবিত্ত মারাঠি পরিবার বিথোভা ডোলাস আর রত্নাপ্রভা ডোলাসের। ছোট্ট একটা চাকরি করে ৫ সন্তানের পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে যখন হিমশিম খাচ্ছে কর্তা ডোলাস, তখনি আরো এক সন্তানের আগমনী বার্তা জানালো রত্নাপ্রভা। পৃথিবীর আলোর পাশাপাশি অভাবের অন্ধকার দেখলো ডোলাস পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য মহিন্দ্র ডোলাস। দিনটা ছিলো ১৯৬৬ সালের ১৫ই অক্টোবর…
জন্মই যেনো আজন্ম পাপ মহিন্দ্র’র জন্যে। একদিকে অভাব অনটন, আর অন্যদিকে ৬ সন্তান থাকায় কারো দিকেই যথেষ্ট মনোযোগ দেয়া সম্ভব ছিলো না তার বাবা-মা’র পক্ষে। তবুও সব বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে ভালো ছাত্রের তকমা লেগে যায় মহিন্দ্র ডোলাসের গায়ে। বেশ ভালো রেজাল্ট করে স্কুলের গন্ডি পার করে সে। তারপর আইটিআই-তে ভর্তি হয় মহিন্দ্র।
সময়টা ১৯৮০ সাল, বোম্বে’র উপর শাসন চলছে ডন দাউদ ইব্রাহীমের। দুবাই-তে বসে কয়েকজন বিশ্বস্ত লোকের উপর নির্ভর করে দাউদ পরিচালনা করছে এক বিশাল অপরাধ সাম্রাজ্য। দাউদের ডি-কোম্পানি’র নামে বড় বড় নেতা মন্ত্রী ব্যবসায়ী সবাই তটস্থ। ইন্ডিয়ায় অবস্থানরত যাদের উপর নির্ভর করে দাউদ তার কার্যক্রম চালাচ্ছিলো, তাদেরই একজনের নাম অশোক জোশী। এই অশোক জোশী আবার কেন্দ্রীয় সরকারের একজন নির্বাচিত এমএলএ। সরকারি নেতা হওয়া সত্ত্বেও অশোকের নিজস্ব সন্ত্রাস বাহিনী ছিলো। সেই দলে যোগ দেয় সদ্য স্কুলের গন্ডি পেরোনো মহিন্দ্র ডোলাস। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর প্রচন্ড সাহসিকতার উপর ভর করে খুব দ্রুত অশোকের খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠে মহিন্দ্র। অশোকের অর্ডারে সব বড় বড় অপারেশনের নেতৃত্ব দেয় মহিন্দ্র ডোলাস। ততদিনে আন্ডারওয়ার্ল্ডে মায়া ভাই নামে পরিচিত হয়ে গেছে সে। দু’হাতে তখন অর্থ উপার্জন করছে মায়া ডোলাস ! বিনিময়ে খুন, গুম, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ যেকোন অন্যায় করতে কোনো আপত্তি নেই তার। অশোক জোশী’র লোক হওয়ায় তাকে বাঁধা দেবার মতও কেউ নেই।
১৯৮৮’র ডিসেম্বরে অশোকের প্রতিদ্বন্দ্বী ইব্রাহীমের অর্ডারে ‘ছোটা রাজন’ নামের এক সন্ত্রাসী তার দলবল নিয়ে খুন করে অশোক জোশী-কে।
অশোকের মৃত্যুর পর ওই গ্যাং থেকে বেরিয়ে এসে নিজস্ব দল গঠন করে মায়া। এই নিয়ে অশোকের দলের সাথে বিরোধ হয় তার। এই সময় অশোকের দলের শ্যুটার দিলীপ বুয়া যোগ দেয় মায়ার সাথে। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মায়া-দিলীপের প্রথম প্ল্যান ছিলো অশোকের গ্যাং ধ্বংস করা। প্রথম অপারেশনেই কাঞ্জুর মার্গ নামক গ্রামে অশোকের দলের প্রধান ৬ সন্ত্রাসীকে হত্যা করে মায়ার গ্যাং। এরপর মায়া’র উপর নজর পরে দাউদের। সরাসরি দাউদের আন্ডারে কাজ করায় তার প্রসার বাড়তে থাকে খুব দ্রুত এবং ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠে মায়া। ফলে একসময় দাউদের আদেশ অমান্য করতে শুরু করে সে।
১৯৯১ সালের ১৬ই নভেম্বর, বোম্বের আঁন্ধেরি এলাকার লোখন্ডওয়ালা কমপ্লেক্সের ফ্ল্যাট নাম্বার ০০২। এখানেই এক জরুরী মিটিংয়ে মিলিত হয়েছে মায়া এবং দিলীপ সহ তাদের দলের মোট ৭ জন সদস্য। এই অবস্থায় বিল্ডিংটি চারদিক থেকে ঘিরে ধরে বোম্বে পুলিশ আর ATS (এ্যন্টি টেরোরিস্ট স্কোয়াড) এর সদস্যরা। তাদের নেতৃত্বে ছিলো পুলিশ কমিশনার আফতাব আহমেদ খান। প্রায় চারঘন্টা ব্যাপী গোলাগুলির পর মায়া’র গ্রুপের সবাই নিহত হয়। নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডে পুলিশের পক্ষ থেকে প্রায় সাড়ে চারশ রাউন্ড গুলি খরচ করা হয়। ঐতিহাসিক এই শ্যুটআউটটির বেশ কিছু অংশ একজন পুলিশ সদস্যের দ্বারা ভিডিও রেকর্ড করা হয় এবং সেটা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ওই অপারেশনে মায়া’র কাছ থেকে নগদ ৭ লাখ রুপি উদ্ধার করা হয় বলে জানায় কমিশনার আফতাব আহমেদ খান। বেশ কয়েকবার তদন্ত করেও মায়া’র বিরুদ্ধে কোনো নির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমান করতে পারেনি পুলিশ। তবে জানা যায় যে দাউদ ইব্রাহীমের আদেশেই সেদিন আফতাব খান গিয়েছিলো মায়া এবং দিলীপ বুয়াকে খুন করতে।
এই শ্যুটআউটের পর বেশকিছু মানবাধিকার সংস্থার চাপের মুখে পরে পুলিশ এবং প্রশাসন। যার ফলে আদালতে উপস্থিত হতে হয় কমিশনার খান এবং সংশ্লিষ্ট ATS অফিসারদের। সেখানে তারা মায়া’র বিরুদ্ধে কোনো যৌক্তিক প্রমাণ দেখাতে না পারলেও তাদের বেকসুর খালাশ দেয়া হয়।
২০০৭ সালে এই ঘটনার উপর কেন্দ্র করে বলিউডে একটি সিনেমা নির্মিত হয়, যার নাম ‘শ্যুটআউট অ্যাট লোখন্ডওয়ালা ‘। সিনেমায় মায়া’র চরিত্রে বিবেক ওবেরয়, দিলীপ বুয়া’র চরিত্রে তুষার কাপুর এবং কমিশনার আফতাব আহমেদ খানের চরিত্রে সঞ্জয় দত্ত অভিনয় করেন। মায়া’র মা রত্নাপ্রভা এই সিনেমা ব্যান করার দাবীতে একটা মামলা দায়ের করেন। তার অভিযোগ ছিলো, সিনেমায় মায়া এবং রত্নাপ্রভা’র চরিত্র সম্পর্কে ভুল এবং বানোয়াট গল্প উপস্থাপন করা হয়েছে। মামলার রায়ে সিনেমার শুরুতে “এই সিনেমার সকল চরিত্র কাল্পনিক, জীবিত কিংবা মৃত কোনো ব্যাক্তির সাথে সিনেমার কোন চরিত্রের মিল থাকলে তা সম্পূর্ন কাকতালীয়” -নোট শো করতে বাধ্য হয়।
আরেকটা মজার বিষয় হচ্ছে, মায়া ডোলাসের চরিত্রে অভিনয় করা বিবেক ওবেরয়ের চেহারাও অনেকটা মিলে যায় মায়া ডোলাসের সাথে !