ফাগুন হাওয়ায় ‌আবুল হায়াত এক নিঃসঙ্গ শেরপা

সিনেমা দেখার সময় গুজব রটেছিলো, আবুল হায়াত নাকি হেলিকপ্টারে করে সব সিনেমাহলে যাচ্ছেন, ‘ফাগুন হাওয়ায়’ দেখতে আসা দর্শকদের সাথে দেখা করতে। আমি তখন সিনেমা দেখায় মগ্ন। আবুল হায়াত আসবে শুনে আমি আমার ছোট্ট মস্তিস্কের উপর চাপসৃষ্টি করে একসাথে দুইদিকে মনযোগ স্থাপন করলাম। মাথার একপাশ যখন সিনেমার দৃশ্যগুলোর আবেদন গ্রহণ করার চেষ্টায় মগ্ন, অন্যপাশ জুড়ে তখন চলছে আবুল হায়াত দর্শনের ভাবনা। ভাবতে ভাবতে সিনেমা শেষ হয়ে গেলো, আবুল হায়াত আর হেলিকপ্টার নিয়ে এলো না…

রাতেই আমি হলের সামনে এসে বসে ছিলাম। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আবুল হায়াতের সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। যেভাবেই হোক, প্রথম শো’টা আমাকে দেখতেই হবে। তাই ছোটভাইকে নিয়ে সারারাত মধুমিতা হলের সামনে বসে ছিলাম। বসেই ঘুমিয়ে গেছি। সকালবেলায় যখন মাছরাঙা পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে, আমি চোখ মেলে দেখি চারিদিকে শুধু আবুল হায়াত আর আবুল হায়াত। বৃদ্ধ জোয়ান, শিশু কিশোর, নরনারী, কপোত কপোতী, ছোটলোক বড়লোক সব শ্রেণীর মানুষেরা আবুল হায়াতের মুখোশ পরে টিকেট কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছে। এ যেনো এক স্বপ্নের জগতে আমি চলে এসেছি !

চোখমুখ ডলে আমি টিকেট কাউন্টারের দিকে ছুটলাম। কাউন্টারের লোক বললো, “টিকেট তো সেই ভোরবেলায়ই বেচা হয়ে গেছে। পোস্টার দেখে বাসায় চলে যান।”

জীবনে এই প্রথমবার ব্লকবাস্টার এবং সিনেপ্লেক্সের বাইরে অন্য কোনো সিনেমাহলে এসেছি। অনেক নিয়মই জানিনা। ছোটভাই অরিত্র বললো, ব্লাকে টিকেট কেনা যায়। আমরা বাধ্য হয়ে ব্লাকে টিকেট কিনলাম। যার কাছ থেকে টিকেট কিনেছি, সেও আবুল হায়াতের মুখোশ পরা। আমরা বিভ্রান্ত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছি, “বন্ধু তুমি কি অরিজিনাল? তোমার কাছে টিকেট এলো কোত্থেকে?”

… সে কিছু না বলে চলে গেলো !

বহু টানাপোড়েনের পর যখন হলে গিয়ে ঢুকলাম, পর্দায় তখন আবুল হায়াতকে দেখা যাচ্ছে। পাকিস্তানি পুলিশ যশপাল শর্মাকে ধমকাচ্ছে আমার প্রিয় অভিনেতা ! এটুকু দেখে আমি ধরেই নিয়েছিলাম, এ ছবিতে আমরা এক ভিন্ন আবুল হায়াতকে পাবো, যে হবে প্রতিবাদী চরিত্র, নৈতিকতার অগ্নিকুন্ড। পুরো সিনেমা জুড়ে সে শুধু প্রতিবাদ করবে। মানুষকে শাসন করবে। কোথাও কোনো অন্যায় হতে দেখলে এগিয়ে গিয়ে বলবো, এই তুমি এটা কি করছো?

আমি ভেবেছিলাম, বাবুর বউকে পাকিস্তানি পুলিশ দরজা লাগিয়ে ধর্ষণ করার সময় আবুল হায়াত গিয়ে দরজা ভেঙে মেয়েটিকে উদ্ধার করে আনবে। আমি ভেবেছিলাম, বাংলা ভাষায় লালনের গান গাওয়ার অপরাধে বাউলের চুল কাটার সময় আবুল হায়াত ধমক দিয়ে বলবে, খবরদার কেউ ওর চুল ধরবেনা। আমি ভেবেছিলাম, আইনের রক্ষক হয়েও আইনভঙ্গকারী পুলিশ অফিসারের পাখি গুলি করার সময় আবুল হায়াত গিয়ে বলবে, তুমি গুলি করলে কেনো? তুমি জানোনা পাখি শিকার করা অপরাধ? আমি ভেবেছিলাম, বাঙালিদের জোর করে উর্দু ভাষা শেখানোর সময় আবুল হায়াত উর্দুশিক্ষক ফারুকের মুখে ঘুষি দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে বলবে, ‘কোনো কথা হবেনা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই…’

আবুল হায়াত কোনোটাই করেননি ! বরং সিনেমায় যে কয়েকটা হাসির অ্যাকশন দৃশ্য ছিলো, সেগুলো পর্দাজুড়ে ভেসে বেড়ানোর সময়টাতেও আবুল হায়াতের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। কোথায় ছিলেন তিনি?

আমি তাঁর দোষ দিচ্ছিনা। সিনেমার প্রেক্ষাপটের সাথে মিল রেখেই হয়ত তাকে এ চরিত্রটি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাই বলে এত কম সময় তাকে দেখাবে? পুরো সিনেমাজুড়ে সবমিলিয়ে মাত্র পাঁচ মিনিটের মত তাঁকে দেখানো হয়েছে। অথচ আমরা যারা হলে গিয়ে সিনেমাটি দেখেছি, তাদের অধিকাংশই টাকা খরচ করে এতদুর গেছি শুধুমাত্র আবুল হায়াতকে দেখার জন্য !

… এখন আপনি বলবেন, সিনেমার মূল ম্যাসেজটা গ্রহণ না করে আবুল হায়াতকে কেনো টানছি?

সিনেমার মূল ঘটনা না দেখে এই দুই ঘন্টা নিশ্চয়ই আমি মুড়ি চাবাইনি ! আমি শুধু বিরক্ত হয়েছি। শুধুই বিরক্ত !! কারণগুলো শুনুন…

ছবির শুরুতে দেখা যায় লঞ্চে উঠার সময় পাকিস্তানি বদমাশ পুলিশ অফিসার যশপাল আবুল হায়াতকে ধাক্কা দেয়। আবুল হায়াত সেখানে তর্ক করতে গিয়েও থেমে যায়। এরপর তারা লঞ্চে গিয়ে উঠে। আমি ভেবেছিলাম, এবার হয়ত শক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে টাইটানিকের মত এই লঞ্চটাও ডুবে যাবে। জলডোবা আবুল হায়াতের দেখা মিলবে। কিন্তু এরকম কিছুই হলোনা ! পরের দৃশ্যে তিশা রুমের বাইরে গিয়ে সিয়ামের সাথে কথা বলে। আবুল হায়াত তখন ভেতর থেকে ডেকে তিশাকে ঘরে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। অথচ এতটা সংকুচিত মনের চরিত্রে তাঁকে অভিনয় করতে দেয়ার কোনো মানে ছিলো না। পরের দৃশ্যে তারা গ্রামে যাবার সময় তাদের গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। মানে বুঝানো হলো, আবুল হায়াত যেদিকে যায়, সেদিকেই কুফা লেগে যায় !

যাই হোক, এরপর তারা সিয়ামের গরুর গাড়িতে চড়ে বাড়ি যান। বাসায় পৌঁছে জামাকাপড় চেঞ্জ না করেই তিনি তিশাকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গাইতে বসিয়ে দেন। পুলিশ অফিসার যশপালের জ্বর হয়। সে তার ফোর্স পাঠিয়ে আবুল হায়াতকে অ্যারেস্ট করার হুমকি দিয়ে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায় জ্বরের চিকিৎসা করার জন্য। এরপর থেকে আবুল হায়াত গায়েব !

পরে অবশ্য তিনি আবারো ফিরে এসেছিলেন। কি ঘটেছিলো আবুল হায়াতের সাথে, তা নাহয় সিনেমা দেখেই জেনে নিবেন।

বলছি না যে সিনেমাটা খারাপ হয়েছে। আমি শুধু এটুকুই বলছি, কেনো জানি আমার মন ভরেনি। এই আবুল হায়াতকে দেখার স্বপ্ন নিয়ে আমি সিনেমা দেখতে যাইনি !

আমি ধরেই নিয়েছিলাম, পুরো সিনেমাজুড়ে আবুল হায়াত ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। প্রতিটা দৃশ্যে প্রতিটা চরিত্রের সাথে আবুল হায়াতকে নানান বিষয়ে মত-দ্বিমত পোষণ করতে দেখা যাবে। প্রতি মিনিটে প্রতিটা দৃশ্যেই আবুল হায়াত উপস্থিত হয়ে সিনেমায় নিজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এমনি গানের দৃশ্যেও থাকবে। গানের দৃশ্যে তাকে রাখার প্রয়োজন না হলে অন্তত এক সাইডে হালকা করে পেছন থেকে তার পিঠ দেখানো হোক ! ছবি তোলার সময় ছোট বাচ্চারা যেভাবে সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে, আবুল হায়াত ঠিক সেভাবেই ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকুক। তবুও তাঁকে দেখতে চাই…

‘ফাগুন হাওয়ায়’ সিনেমাটি ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত হয়েছে। আমি ভাষা আন্দোলন সহ একজন বাঙালির যাবতীয় চেতনাকে সম্মান করি, ধারণ ও বহন করি। শুধুমাত্র এ কারণেই সিনেমাটি নিয়ে নেগেটিভ কিছু বললাম না। তা নাহলে হুংকার দিয়ে বলতাম, ‘কেনো আবুল হায়াতকে মাত্র ৫ মিনিট দেখাবে? তবে কি তার অশ্লীল দৃশ্য সেন্সর বোর্ডে কাটা পরেছে? এজন্যই কি সিনেমায় তার রসায়ন এত কম?’

ফাগুন হাওয়ায় আবুল হায়াত ফাগুনের মতই এসেছিলো। ফাগুনের মতই ‌উঁকি মেরে চলে গেলো ! যতক্ষণ পর্যন্ত পর্দায় আবুল হায়াত ছিলেন, ততক্ষণ হলের ভেতর চিৎকার চেচামেচি ও দর্শকদের উল্লাস লক্ষ্য করা গেছে। পাশের সিট থেকে দুই যুবতী বারবার আমাদের বলছিলো, “আপনারা চুপ করুন। কথার আওয়াজে কিছু শুনতে পাচ্ছিনা”। আওয়াজ থেমে গেছে। মেয়ে দুটোর কথা শুনে ‍কেউ চুপ হয়নি। দৃশ্যগুলো থেকে যখনই আবুল হায়াত ছিটকে পরেছে, তখনই দর্শকদের উল্ল‍াস মুখরতা থেমে গেছে !

সিয়ামদের বন্ধু সংঘের একজন হয়ে অভিনয় করেছেন সাজু খাদেম। এই সাজু খাদেমকে একসময় আমি বলিউডের আরশাদ ওয়ার্সি ভাবতাম। গোলমাল সিনেমার অজয়ের সাথে যে লোকটা। সাজুর সাথে অনেকটা মিলে যায়। সাজুর কত নাটক সিডি কিনে দেখেছি। সেই সাজুকে মূল চরিত্রে দেখতে পারলে আরো ভালো লাগত। অন্তত বোরকা পরে নারী সাজার চরিত্রে নয়।

পরিশেষে এটুকুই বলতে চাই, পুরো সিনেমাটিতে যশপাল শর্মার জঘন্য অভিনয় বাদে আর সবকিছুই আমার কাছে মোটামুটি ভালো লেগেছে। ব্যাপারটা এমন না যে আমি বাংলা চলচ্চিত্রে ভারতীয় তারকার আগমনের বিপক্ষে। ব্যাপারটা হচ্ছে, যেই যশপাল শর্মা হিন্দি সিনেমায় তুষার কাপুরের ঘুষি খায়, ভিলেন হয়ে সিনেমার পর্দায় অমুক বোন তমুকের বান্ধবীকে রেপ করে বেড়ায়। সেই যশপাল শর্মাকে সিনেমার পোস্টারে একেবারে সামনে বড় করে তুলে দেয়া আমার ভ‍ালো লাগেনি। ভালো কথা, তাকে রাখবেন, রাখুন। আবুল হায়াত এবং ফজলুর রহমান বাবু’র মত দেশীয় প্রবীণ অভিনেতাদের ছবি এত চিপার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হবে কেনো? এইটা আমি মানতে পারিনি। অনেক চেষ্টা করেও ফাগুন ‍হাওয়ায় সিনেমার পোস্টারের আবুল হায়াতের সাথে একটা সেলফি তুলতে পারিনি আমি ! ফজলুর রহমান বাবুর উপস্থিতিটা আরেকটু বেশি হতে পারত। আর উপরে এতক্ষণ আবুল হায়াতকে যতটুকু দেখতে চাওয়ার কথা বললাম, ততটুকু নয়, তারচেয়ে অন্তত চারভাগের তিনভাগ কমিয়ে দেখালেও পুষিয়ে নেয়া যেত। ট্রেইলার দেখেই অনেকে বুঝে নিয়েছে, সিনেমায় আবুল হায়াতের খুব একটা সরব উপস্থিতি নেই। ভাষা আন্দোলনে কি ঘটেছে, সেটাও কমবেশ সবার জানা। এ কারণেই মানুষ সিনেমাটি দেখতে খুব একটা সিনেমাহলে যাননি ! পুরো হল ফাঁকাই পরে ছিলো। আমরা ৮ জন দর্শক এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আরাম করে ছবি দেখলাম…

মাত্র ৮ জন মানুষ আবুল হায়াতের ছবি দেখতে সিনেমাহলে গিয়েছে, এই কথা আমি কোন মুখে বলবো? তাই ‘হেলিকপ্টার’ গুজবের মত আমিও একটু গুজব সাজিয়ে বললাম, ‘ফাগুন হাওয়ায়’ দেখতে আজ অনেক দর্শক হয়েছে। চারিদিকে শুধু ভিড় আর ভিড়। ভিড়ের কারণে সিট পাইনি। চা দোকানদারকে হুমকি ধামকি দিয়ে বেঞ্চ কান্ধে তুলে হলের ভেতর নিয়ে গেছি, কোনোরকমে হেলান দিয়ে বসে বন্ধুকে দেখার জন্য !

আমি মনে করি, পুরো সিনেমায় এন্ট্রি থেকে এন্ডিং পর্যন্ত আবুল হায়াত একা একাই লড়ে গেছেন। কখনো অভিনয়ে, আবার কখনো নিজের চরিত্রের চিত্রায়নে। আবুল হায়াত একাই টেনে নিয়ে গেছেন পুরো চলচ্চিত্রটা। এই সিনেমায় আবুল হায়াত মূলত একজন নিঃসঙ্গ শেরপা !

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আমাদের নতুন প্রজন্মের জানা উচিত। অবশ্যই পরিবার পরিজন নিয়ে ‘ফাগুন হাওয়ায়’ দেখুন। আমার লেখা পড়ে বিভ্রান্ত হবেন না। নিজে দেখে যাচাই করুন, সোশ্যাল মিডিয়ায় যারতার কথায় কান দেয়া উচিত কি উচিত না !