ব্যাট আর অস্ত্র দুটোই ভালো চালাতেন ক্রিকেটার মমিনউল্লাহ ডেভিড

ক্রিকেটে ভালো সুনাম কামিয়েছিলেন মমিনউল্লাহ ডেভিড ! ভালো ক্রিকেট খেলতেন নারায়ণগঞ্জের এই যুবদল নেতা। কিন্তু রাজনীতির পথে হাঁটতে গিয়ে ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে বেশিদুর আর আগাতে পারেননি। হাতে তুলে নিলেন অবৈধ অস্ত্র। খুন, চাঁদাবাজি আর টেন্ডারবাজি করতে করতে একসময় হয়ে ওঠেন নারায়ণগঞ্জের শীর্ষ সন্ত্রাসী ! পুলিশও তার হাত থেকে রেহাই পায়নি। পুলিশকে মারধর করে গুলি ছিনিয়ে নেওয়ার মত ঘটনাও ঘটিয়েছেন এই ডেভিড !

একটা সময় রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান তিনি। কোনোভাবেই তার লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছিলো না। একরকম সন্ত্রাসের জনপদেই পরিণত হয়ে গেলো নারায়ণগঞ্জ। পুলিশের হিসেব অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন থানায় খুন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, হামলা সহ ডেভিডের বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা ছিলো।

মমিনউল্লাহ থেকে ডেভিড হলেন যেভাবে

ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ ক্রিকেট একাডেমীতে। ভালো ব্যাটিং করতেন। আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করতেন অস্ট্রেলিয়ান জনপ্রিয় ক্রিকেটার ডেভিড বুনকে। ডেভিড বুনের ব্যাটিং স্টাইল রপ্ত করেছিলেন ভালোভাবেই। আর তাই ক্রিকেট একাডেমীর কোচ তাকে ডেভিড বলেই ডাকতেন। সেই থেকে তার নাম হয় মমিনউল্লাহ ডেভিড ! পরিচিতি পান ডেভিড নামে…

ক্রিকেট খেলতে খেলতে এই ডেভিড এক সময় জড়িয়ে পড়েন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে। ক্রিকেট ব্যাট চালাতে তিনি যেমন পারদর্শী ছিলেন, অস্ত্রও চালাতেও পারদর্শী ছিলেন ঠিক তেমনি। একসময় অস্ত্র আর ব্যাট দুটোই চালাতে শুরু করলেন। সময়ের পরিক্রমায় ক্রিকেট ব্যাটের বদলে নিত্যনতুন অস্ত্র শোভা পেতে থাকে তার হাতে। সন্ত্রাসী থেকে বনে যান শীর্ষ সন্ত্রাসীতে। অল্প সময়েই তিনি হয়ে ওঠেন নারায়ণগঞ্জের অপরাধ জগতের ডন !

মমিনউল্লাহ ডেভিড এর বড় বোন সুলতানা রাজিয়া দিদি। ডেভিড দিদির মিশনপাড়ার বাসাতেই থাকতেন। অভিযোগ রয়েছে, বোনের মদদ পেয়েই ডেভিড হয়ে ওঠেন দুর্ধর্ষ। ডেভিডের প্রত্যেকটি কাজে দিদির ইন্ধন থাকতো।

১৯৯০ সালে ডেভিড সন্ত্রাসের পথে হাঁটতে থাকলেও সেসময় তিনি খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। কারণ তখন বিএনপি সমর্থক প্রায় ২ ডজন সন্ত্রাসী দেশব্যাপী বেপরোয়াভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিলো। পরে আওয়ামীলীগ সরকার আমলে ওই অপরাধীরা গা-ঢাকা দিলেও আড়ালে যাননি ডেভিড। এলাকায় থেকেই গা-ঢাকা দেওয়া অপরাধীদের আস্তানাগুলো দখলে নিতে শুরু করেন। ২০০১ সালে বিএনপি পূনরায় ক্ষমতায় আসায় এতকাল পর্যন্ত টিকে থাকার ফলস্বরুপ মমিনউল্লাহ ডেভিডের ভয়ংকর সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ হিসেবে উত্থান ঘটে। বাঘা বাঘা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে অপরাধীরা পর্যন্ত তার কাছে তখন বা‍ঁ হাতের ময়লা। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় আরো দ্রুত এগিয়ে যান ডেভিড। পরিণত হন অপরাধ সাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাটে  !

তার কাছে অস্ত্র যেনো একটি খেলনা বস্তু। প্রকাশ্যেই অস্ত্র নিয়ে দাঁপিয়ে বেড়াতেন শহরের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত। পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারী অফিস আদালতও তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিলো। কোনো কিছুতেই তার এই অগ্রযাত্রাকে রোধ করা যাচ্ছিলো না। অত্যাধুনিক অস্ত্রের মজুদ গড়ে তোলেন তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে।

মূলত এরশাদ আমলে ১৯৮৮ সালে জোড়া খুনের মাধ্যমে আলোচনায় আসেন ডেভিড। কালাম ও কামাল নামে দুই যুবককে হত্যা করেন ডেভিড। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর কিছু করতে না পারলেও ২০০১ সালের পর তৎকালীন ছাত্রদলের এই নেতা একরকম ভয়ানক দানবে পরিণত হয়। খুন, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে নারায়ণগঞ্জের সব ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তিনি। আওয়ামীলীগের অসহযোগ আন্দোলনে সশস্ত্র হামলা চালান তিনি। আর এতে ‘পাণ্ডা’ নামে এক যুবক নিহত হন। এছাড়া মিশনপাড়া এবং চাষাঢ়ায় গুলি করে হত্যা করেন মনির নামে এক যুবককে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন রাজনীতির আশ্রয় প্রশ্রয়ে ডেভিড সোনার হরিণ হিসেবে বেছে নেয় সন্ত্রাসকে। এ পথ ধরে ডেভিড কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হাসিলে অনেক দূর এগিয়ে গেছিলেন। সেই আমলেই তার প্রতিদিন অবৈধ আয় ছিলো ৭০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ পর্যন্ত !

ডেভিডের এই অবৈধ আয়ের উৎস ছিলো সব ধরনের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, শীতলক্ষ্যা নদীর চাঁদাবাজি, গার্মেন্ট জুট ব্যবসা, চোরাই তেল ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সন্ত্রাসের মহীরুহে পরিণত হন ডেভিড। অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের ভাণ্ডার গড়ে তোলেন নারায়ণগঞ্জে। ডেভিডের আমলে টেন্ডারকে নারায়ণগঞ্জে প্রায় প্রতিদিনই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটত। সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, অনেকেই তার হাতে প্রকাশ্যে নাজেহাল হয়েছেন। কিন্তু ভয়ে কেউ টুঁ শব্দটি করার সাহস পেত না…

সূত্রমতে, নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের ব্যবসায়ীরা ছিলেন মমিনউল্লাহ ডেভিডের কাছে জিম্মি। এমন কোনো ব্যবসায়ী ছিলেন না, ডেভিড ও তার গ্যাংয়ের নির্যাতন সহ্য করেননি। তাদের চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য এমনটাই বেড়ে যায় যে, কোনো ব্যবসায়ী এলসি খুললেই চাঁদা দিতে হত।

অবশেষে দল ক্ষমতায় থাকতেই একদিন র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন মমিনউল্লাহ ডেভিড !

নারায়ণগঞ্জের কিছু পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৫ সালের ২৪ নভেম্বর ড্রেজারের একটি টেন্ডারের শিডিউল জমা নেওয়া হয়। ডেভিডের অনুগতরা শিডিউল জমা দেয় দুপুর ১২টায়। এরপর সে মোটা অংকের টাকা প্রদানের জন্য এক এমপির কাছে যায়। সেখানে টাকা দিয়ে রাতে ঢাকায় যাওয়ার সময়ে মালিবাগ এলাকায় র‌্যাবের ক্রসফায়ারে মমিনউল্লাহ ডেভিড নিহত হন। তার মৃত্যুর পর শহরের মিশনপাড়া এলাকায় জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। ডেভিডের মৃত্যুর পর তার নামের উপর ভর করা অন্য ভাইরাও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় !

এভাবেই শেষ হয় ডেভিডের অন্ধকার জীবনের কালো অধ্যায় !

(তথ্যসুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন, উইকিপিডিয়া, ডেইলিস্টার)