বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষন এর ভিডিও দেখেছিলেন কি? সাদা পাঞ্জাবি ও কোট পরিহিত একজন নেতা লাখো জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছে , মুক্তিকামী জনতাকে দেখাচ্ছে স্বপ্ন। সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি ময়দানের অপর প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব বহন করেছিল একটি মাইক পরিসেবা সার্ভিস। যার নাম কল রেডি। বিভিন্ন ভাষন বা মঞ্চে ভাষন দেয়ার জায়গায় কালো বোর্ডের সাদা কালিতে লেখা কল রেডি লেখাটি হয়ত দেখে থাকবেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে এবং পুর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন আন্দোলনে প্রায় সব সময় এ মাইক সার্ভিসটি ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় সভা ও সমাবেশে এবং সাতই মার্চের ভাষণ উল্লেখযোগ্য ।
কল-রেডীর মাইক দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী, ইয়াসির আরাফাত, নেলসন ম্যান্ডেলা, বিল ক্লিন্টন, প্রণব মুখার্জী ও অটল বিহারী বাজপেয়ী প্রভৃতিব্যাক্তিবর্গ, এরা বাংলাদেশের কোন সফরে এসে যে অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদান করতেন তখন এ মাইক ব্যাবহার করা হতো। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলও অধিকাংশ সময় কল-রেডী ব্যবহার করে।
কল-রেডী’র গল্প
হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ নামে দুই ভাই, পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা। দেশভাগের পর সব যখন আবার স্বাভাবিকের দিকে, তখন বাবা তাদের ব্যাবসায় নামার পরামর্শ দিলো। বাবার ইচ্ছে ছিল ইসলামপুরে থান কাপড়ের পাইকারি দোকান দেবেন, কিন্তু দু’ভাইয়ের আগ্রহ ছিল না এ ব্যবসায়। কারণ, এমন দোকান পুরান ঢাকায় অহরহ। এমন পরিস্থিতিতে খুব একটা লাভজনকও নয়। তারা ঠিক করলো বাতি বা লাইটের ব্যাবসা করবে। পুরান ঢাকার মানুষ জাকজমক পছন্দ করে , তাদের ধারনা ব্যাবসা বেশ ভালই চলবে। দুই ভাই ১৯৪৮ সালে পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে ‘আরজু লাইট হাউস’ নামে একটি দোকান চালু করেন । তাদের প্রথম কাস্টোমার ছিল স্থানীয় শ্যামলকান্তি বড়াল, ৩ টাকা এডভান্স দিয়ে বিয়েবাড়ির আলোকসজ্জার দায়িত্ব দিয়ে যান দুই ভাইকে। কিন্তু লাভবান ব্যাবসা হওয়ায় আশে পাশে গড়ে উঠতে শুরু করলো অনেক দোকান। শেষে তাদের ব্যাবসাই ডোবার পথে।
এমন সময় অনেকটা বুদ্ধি খাটিয়েই লাইটের পাশাপাশি সাউন্ড সিস্টেম যুক্ত করার কথা চিন্তা করেন তারা। শুরুতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গ্রামোফোন ভাড়া ও আলোকসজ্জার কাজ করতেন। চাহিদা দিন দিন বাড়তে লাগলো । ভারত থেকে কয়েকটি মাইক অামদানি করে এবং তারা নিজেরা কিছু হ্যান্ডমাইক তৈরি করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা-সমাবেশে ভাড়া দেওয়া শুরু করেন। কিন্তু দিন দিন চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চীন, তাইওয়ান ও জাপানসহ অন্যান্য দেশ থেকেও মাইক আমদানি করেন। যেহেতু লাইটের সাথে সাউন্ড সিস্টেম যুক্ত হয়েছে, তাহলে প্রতিষ্ঠানের নাম তো আর আরজু লাইট হাউজ রাখা যায় না। নতুন নামের স্বীদ্ধান্ত এলো। পাশেই ছিল জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়), নাম চাওয়া হলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে , দেয়া হবে পুরষ্কার। কলেজের এক ছাত্রের দেয়া নামেই কোম্পানীর নাম ঠিক করা হয় ‘কল-রেডী’। ইংরেজী শব্দ Call – Ready অর্থাৎ ‘মাইক যারা ভাড়া করবেন তারা কল (ডাকলে) করলে যাতে তাদের প্রতিষ্ঠান রেডী (প্রস্তুত) থাকেন।’ সে ভাবনা থেকে কল-রেডী নামটি এসেছে। এ মাইক সার্ভিসে ১৯৫৪ সাল নাগাদ কর্মী সংখ্যা ২০ জন অতিক্রম করে।
৭ ই মার্চের ভাষণ
৭ই মার্চের পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমান তার ধানমন্ডির বাসভবনে হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ দুজনে ডেকে রেসকোর্সে ময়দানে মাইক প্রস্তুত করতে বলেন। সমাবেশের তিনদিন পূর্বেই তারা রাতের আধারে মাইক প্রস্তুত করেন এবং সেগুলো ঢেকে রাখেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছু মাইক মজুদ রেখেছিলেন। ৭ই মার্চের ভাষণের সময় যে মাইক্রোফোন, মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ড ব্যবহার করা হয়েছিল তা বর্তমানে কল-রেডির কাছে সংরক্ষিত আছে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্সে ময়দানে (বর্তমান সোহওয়ার্দী উদ্যান ) বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের প্রাক্কালে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক এক ভাষণ প্রদান করেন কল-রেডী মাইক ব্যবহার করে।
দেশের ইতিহাসের অংশ এই প্রাচীন দোকানটি। বর্তমানে ৩৬, এইচকে দাস রোড, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর থেকে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে সেবা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের কাছে এখনো সংরক্ষিত আছে ঐতিহাসিক মাইকগুলো। একটি ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানও যে দেশের ইতিহাসের একটি অংশীদার হতে পারে এরমত সুন্দর উদাহরন আর কি বা হতে পারে।