মূল ঘটনাঃ- হযরত দাউদ (আঃ) এর একদল অনুসারী একবার তার কাছে উপস্থিত হয়ে জানালো তারা হাশরের মাঠের বিচারের নমুনা দেখতে চায়। হযরত দাউদ (আঃ) তাদের পরবর্তী ঈদের দিন হাশরের মাঠের বিচারের নমুনা দেখাবেন বলে কথা দিলেন।
প্রাসঙ্গিক ঘটনা ১
হযরত দাউদের (আঃ) সমসাময়িক বনি ইসরাঈলদের মধ্যে একটা ব্যক্তি ছিলো বেশ ধনাঢ্য এবং প্রভাবশালী। তার প্রচুর ধনসম্পদ এবং বিভিন্ন রকমের পশুপাল ছিলো। সবধরণের পশুপালের মধ্যে একটা গাভী ছিলো অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এটা দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি স্বাস্থবান। গাভীর মালিক গাভীটাকে সবসময় নানারকম মালা পরিয়ে সাজিয়ে রাখত। গাভীটা সারাদিন আপনমনে মাঠে চড়ে বেড়াত এবং সন্ধ্যায় গোহালে ফিরে আসত। প্রভাবশালী ব্যক্তির গাভী হওয়ার কারণে কেউ গাভীটার কোনোপ্রকার ক্ষতি করার চেষ্টা করত না।
প্রাসঙ্গিক ঘটনা ২
হযরত দাউদের (আঃ) সমসাময়িক বনি ইসরাঈল বংশের এক বিধবা মহিলা তার এক ছেলেকে নিয়ে নদীর তীরে বাস করত। তারা ছিলো খুবই ধার্মিক। তাদের বাড়ির কাছে ফলগাছ ছিলো, সেই গাছের ফল খেয়েই তারা সারাবছর কাটাত। দুনিয়ার দিকে তাদের কোনো খেয়ালই ছিলো না।
এইভাবে অনেক বছর কাটানোর পর একদিন সেই বিধবা মহিলার ছেলের ফল ছাড়া অন্যান্য খাবারের স্বাদ নেয়ার ইচ্ছা হলো। সে তার মাকে জানালো, সে বাইরে যেতে চায় এবং কাজকর্ম করে টাকা রুজি করে নতুন খাবার কিনে আনতে চায়। কিন্তু মা ছেলের কথায় রাজী হলো না। মায়ের অমত শুনে ছেলে তার মনের ইচ্ছা ত্যাগ করলো।
কিন্তু পরেরদিন দেখা গেলো তাদের ফলগাছে ফল ধরেনি। মা ছেলে দুজনেই খুব অবাক হলো। তারা ভাবলো কোনো কারণে হয়ত আল্লাহ তাদের প্রতি নাখোশ হয়েছেন। ছেলে সেদিন আবার কাজ করার জন্য বাইরে যেতে চাইলেও মা বরাবরের মতই নিষেধ করলো। তারা শুধু পানি খেয়ে সেদিনটা কাটিয়ে দিলো।
কিন্তু তাদের গাছে পরেরদিনও কোনো ফল ধরলোনা। সেই সাথে ঘটলো এক আশ্চর্য ঘটনা। বিকালবেলা একটা হৃষ্টপুষ্ট গাভী এসে সম্পূর্ণ মানুষের ভাষায় বললো, “তোমরা চাইলে আমাকে জবাই করে আমার মাংস খেতে পারো। আমার মাংস তোমাদের জন্য হালাল।” মা ছেলে দুজনেই গাভীর মুখে এরকম মানুষের মত কথা শুনে যারপরনাই অবাক হলেও তারা গাভীর মাংস খেতে সম্মত হলো না। তারা গাভীটিকে তাড়িয়ে দিলো।
তৃতীয় দিনেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। তাদের গাছে কোনো ফল ধরলোনা এবং পূর্বের দিনেই সেই গাভীটা এসে মানু্ষের ভাষায় তাদেরকে তার মাংস খাওয়ার কথা বললো। কিন্তু তারা সেদিনও গাভীটাকে তাড়িয়ে দিলো।
কিন্তু চতুর্থ দিনেও গাছে কোনো ফল না ধরায় তারা দুজনেই খুব দূর্বল হয়ে গেলো। উপরন্তু সেই গাভীটা সেদিনও এসে তাদেরকে তার মাংস খাওয়ার কথা বললো। তখন মা ছেলে ভাবলো নিশ্চই এসবের পিছনে বিশেষ কোনো কারণ আছে। নইলে গাছেই বা কেন ফল ধরবেনা, আর কেনইবা একটা গাভী এসে মানুষের মত কথা বলবে। তারা অনেক ভেবেচিন্তে আল্লাহর নাম নিয়ে গাভীটাকে জবাই করলো। তারপর তার থেকে কিছুটা মাংস রান্না করে খেলো আর বাকী মাংস রেখে দিলো।
মূল ঘটনায় ফেরার আগে বলে দেই, এটা পূর্বোল্লিখিত সেই প্রভাবশালী লোকটার হৃষ্টপুষ্ট সুন্দর গাভীটা।
এদিকে গাভীটাকে জবাই করে খেয়ে ফেলার কারণে যেভাবে গাভীটা রোজই আপনমনে মাঠে চড়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতো, সেদিন আর ফিরলোনা। গাভীর মালিক চারদিকে অনুসন্ধানের জন্য লোক লাগিয়ে দিলো। সে বুঝতে পারলো গাভীটাকে কেউ না কেউ খেয়ে ফেলেছে। তবুও সে অনুসন্ধান চালিয়ে গেলো।
অবশেষে সেই নদীতীরে অবস্থিত বিধবা মহিলার বাড়িতে গরুর কিছু মাংস, চামড়া পাওয়া গেলো। অনুসন্ধানকারী লোকজন তখন এইকথা গাভীর মালিককে জানালো। গাভীর মালিক রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বিধবা মহিলার বাড়িতে গিয়ে অঘটন ঘটানোর জন্য প্রস্তুত হলে তার আত্মীয় স্বজন তাকে পরামর্শ দিলো সে যেনো এই ঘটনা উল্লেখ করে হযরত দাউদের (আঃ) কাছে বিচার চায়।
লোকটা তাই করলো। হযরত দাউদ (আঃ) লোক পাঠিয়ে সেই বিধবা মহিলা এবং তার ছেলেকে দরবারে হাজির করালেন। তারপর তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তারা কেনো এভাবে আরেক লোকের গাভী জবাই করে খেয়ে ফেললো। তারা তখন গাভী জবাইয়ের পুরো ঘটনা খুলে বললো।
গাভীর মালিক ঘটনা বিশ্বাস না করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। হযরত দাউদ (আঃ) আগে থেকেই ওই বিধবা মহিলা এবং তার ছেলের ধর্মভীরুতার কথা জানতেন। তিনি তাদের কথা বিশ্বাস করলেন। তাই তিনি নিজে গাভীর মালিককে গাভীর ক্ষতিপূরণ দিতে চাইলেন। কিন্তু গাভীর মালিক ছিলো অসৎ প্রকৃতির লোক। সে ক্ষতিপূরণ নিতে রাজী হলোনা। সে জানালো সে উপযুক্ত বিচার চায়। পরেরদিন সে আবার হযরত দাউদের (আঃ) দরবারে হাজির হবে, অতএব দাউদ (আঃ) যেনো আজকের মধ্যে বিচারের কথা চিন্তা করে রাখে। এই বলে সে সভা ত্যাগ করলো।
হযরত দাউদ (আঃ) তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে দৈববাণী প্রাপ্ত হলেন। তাঁকে জানানো হলো, গাভীর মালিক লোকটা দীর্ঘ বছর পূর্বে এক সম্পদশালী লোকের দাস ছিলো। তার মুনিব ব্যবসার উদ্দেশ্যে তাকে নিয়ে সিরিয়ার দিকে রওয়ানা হয়েছিলো। সাথে ছিলো পাঁচশো উট বোঝাই পণ্য। লোকটি তখন অতর্কিত আক্রমণ করে তার মালিককে হত্যা করে তার সব সম্পদ হস্তগত করে। তারপর সমস্ত মালামাল বিক্রি করে এসে এই এলাকায় বসতি স্থাপন করেছে। লোকটির যত সম্পদ রয়েছে সবই সেই নিহত লোকটার। এবং পূর্বের সেই বিধবা মহিলা এবং ছেলেটা সেই লোকের স্ত্রী এবং সন্তান। অতএব গাভীর মালিকের সকল সম্পত্তি সহ ওই গাভীটারও মালিক এই বিধবা মহিলা এবং তার ছেলে। অতএব এই গাভীর মাংস খাওয়া তাদের জন্য পাপ হয়নি।
পরেরদিন ছিলো ঈদের দিন। সারা এলাকার লোক হযরত দাউদের (আঃ) কথামত হাশরের মাঠের বিচারের নমুনা দেখার জন্য মাঠে উপস্থিত হলো। সেই গাভীর মালিকও উপস্থিত হলো বিচারের আশায়।
হযরত দাউদ (আঃ) গাভীর মালিককে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি কখনও কোনো ধনবান ব্যক্তির গোলাম ছিলে? এবং সেই লোকের সাথে সিরিয়ায় যাওয়ার পথে তাকে হত্যা করে তার সকল সম্পদ আত্মসাৎ করেছিলে?”
লোকটা দাউদের (আঃ) এহেন প্রশ্নে অবাক হয়ে গেলো। সে আমতা আমতা করে জানালো,এরকম কিছুই হয়নি। সে কখনো কারো গোলাম ছিলোনা এবং সে কাউকে হত্যাও করেনি। তার পূর্বপুরুষই প্রচুর ধনসম্পদের মালিক ছিলো আর সে উত্তরাধিকার সুত্রে এসব প্রাপ্ত হয়েছে।
লোকটা যখন সবার সামনে নির্দ্বিধায় এসব কথা বলে যাচ্ছিলো, এমন সময় তার বাকশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। সাথে সাথেই তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কথা বলতে শুরু করে। তার হাত সাক্ষী দিলো সে নিজে তার মালিককে হত্যা করেছিলো। চোখ সাক্ষী দিলো সে এই ঘটনা দর্শন করেছিলো। এভাবে তার শরীরে প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিলো।
হযরত দাউদ (আঃ) তখন উপস্থিত লোকদের সম্বোধন করে বললেন, “তোমরা হাশরের মাঠের বিচারের নমুনা দেখতে চেয়েছিলে। এই হচ্ছে হাশরের মাঠের বিচারের নমুনা। হাশরের মাঠে যখন মানুষ দুনিয়াতে করা তার সকল অপকর্মের কথা অস্বীকার করবে, তখন তার নিজের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিবে।”
হযরত দাউদ সেই বিধবা মহিলা এবং তার ছেলেকে তাদের সমস্ত সম্পদ বুঝিয়ে দিলেন। এবং এতদিন ধরে তাদের সম্পদ ভোগ করে আসা লোকটিকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করলেন।