বাবা-মার ভুল সিদ্ধান্তেই জন্ম নেয় একেকটি অবাঞ্ছিত শিশু

“সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে আমরা একসাথে থাকি। বিয়ের পর কোনো কিছুতেই নিজেদের বনিবনা হচ্ছে না, তাই বাচ্চাটা নিয়েছি। যত কষ্টই হোক, বাচ্চা হয়ে গেছে। এখন একসাথে থাকতেই হবে।”

বাচ্চাটা একটু বড় হবার পর…

“শুধুমাত্র তোর জন্য তোর মুখ দেখে এই সংসার করতেসি। তুই না থাকলে জীবনটা আজকে অন্যরকম থাকত।”

এই কথাগুলো খুবই কমন। পারিবারিক ঝায়ঝামেলা ও অশান্তির সময় এই কথাগুলো খুব স্বাভাবিক। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন এই কথাগুলো আপনার সন্তানের মন মানসিকতায় কিরকম প্রভাব ফেলছে? বাবা-মার মুখে এধরণের কথা শুনে তার মানসিক অবস্থাটা কেমন হচ্ছে?

বাচ্চাটা কোনো অস্ত্র নয়। বাচ্চা পয়দা করলেই একসাথে টিকে থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আপনাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার মনোমালিন্যতা বা ঝগড়াঝা‍ঁটির মাঝে বাচ্চাটা কিভাবে বেড়ে উঠছে, কোনোদিন সেটা জানতেও পারবেন না । সম্পর্ক ‍টিকিয়ে রাখার জন্য বাচ্চা জন্ম দেয়ার প্রয়োজন হয় না। শুধু প্রয়োজন হয় একটা সুস্থ মন, আন্তরিকতা এবং শ্রদ্ধার !

একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, আমাদের সমাজের একটা বড় অংশ হিপোক্রেসি করে নিজেদের জীবন যেমন নষ্ট করছে, ঠিক তেমনি ভাবে নিজেদের সন্তানদের মানসিকতাকেও নষ্ট করছে। এই বাচ্চাগুলো সাধারণত নিজেকে ঘৃণার পাত্র ভাবতে ভাবতে বড় হয় ! নিজেকে সংসারের বোঝা মনে করে একটা সময় তারা Unwanted Child বা ‘অবাঞ্ছিত শিশু’ হিসেবে নিজেকে মেনে নেয়। ফেরিওয়ালাদের মত তারা ভালবাসার জন্য একেক দরজায় ঘুরে বেড়ায়। আর কোথাও যখন সেই ভালোবাসাটা না পায়, তখন তারা তাদের যাবতীয় দুঃখ, কষ্ট, হতাশা ও অপ্রাপ্তিকে ভুলে থাকতে নিজেদের চারপাশে একটা দেয়াল তুলে নেয়। আশ্রয়হীনতার মধ্য দিয়ে তারা বড় হতে থাকে।

নিজেদের জীবন নতুন করে শুরু করতে পারবেন না ভালো কথা। কিন্তু ‘সমাজ কি বলবে’ এসব চিন্তা করতে গিয়ে আপনারা নিজেদের সন্তানকে কি শিক্ষা দিয়ে বড় করছেন, সেটা কি কখনো ভেবে দেখেছেন?

যে সম্পর্ককে টিকায় রাখার জন্য সন্তান নিচ্ছেন, সেই ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকা সম্পর্কটা দেখে আপনার সন্তান শুধুমাত্র ঘৃণা শিখছে। শিখছে সম্মান না করা, শ্রদ্ধা না করা। বেড়ে উঠছে অপরাধ প্রবনতা নিয়ে ! এদের কেউ হয়ত রাতের পর রাত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সঙ্গী খুঁজছে, ভালবাসা বা আশ্রয় খুঁজছে। মাথার উপরে একটা ছাদ, গায়ে পরিধান করার জন্য দুটো জামা, ক্ষুদা মেটাতে তিনবেলা খাবার, এই সবকিছুকে ছাপিয়ে একটা মানুষের দরকার পরে ভালোবাসার। আর সেই ভালোবাসা পাবার জন্য দরকার পরে একটা মানুষের, যাকে প্রাণ খুলে নিজের কথা বলা যায়। যে খারাপ সময়গুলোতে বলতে পারে, “তুমি একা নয়, আমিও আছি ! যা হয় হোক। একসাথে দেখা যাবে সবকিছু।”

আপনাদের অপূর্ণতার কারণে আপনাদের নিজেদের সন্তানেরা এই অপর আশ্রয়ের দিকে চলে যায়, পরজীবী হয়ে যায় !

“সন্তানদের বখে যাওয়া অসৎ সঙ্গ, অনেক টাকা দিয়েছি ওর পেছনে, যা চেয়েছি তাই কিনে দিয়েছি” – দয়া করে এসব বলার আগে একবার ভেবে বলুন বাবা-মা হিসাবে কতটুকু সময় তাদেরকে দিয়েছেন? সন্তানকে যদি আপনি নিজেই আঙ্গুল তুলে আপনার পারিবারিক কলহ জনিত দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী করেন, তাহলে মনে রাখুন, এই সন্তানকে আপনি নিজেই নিজের দায়িত্বে এই পৃথিবীতে এনেছেন, সে রিকশা নিয়ে নিজদায়িত্বে চলে আসে নাই !

সম্পর্কে যদি টানাপোড়েন চলে আসে, তাহলে নিজেদের মধ্যে সেটা সমাধানের বিষয়ে আলোচনা করুন। আপনার সঙ্গীর দোষ না খুঁজে বরং তাকে বুঝিয়ে বলুন কেনো এমনটা হচ্ছে, বা কেনো ‍‌আর আপনি তার সাথে থাকতে চাচ্ছেন না। দুজনেই সময় নিন। সঙ্গী যদি আপনার উপরে নির্ভরশীল থাকে, তাহলে অর্থনৈতিকভাবে তাকে স্বাবলম্বী হবার সুযোগ দিন। নাহলে তার ভালোর জন্য নিজেই কোনো ব্যবস্থা করুন। সম্পর্কের অবনতির মধ্যে সেটার সমাধান না করে কখনোই বাচ্চা নেয়ার কথা ভাবেন না।

হয় সম্পর্কে উন্নতি করুন, না হয় ঝেড়ে ফেলুন। নিজেও বাঁচবেন, সেইসাথে একটি প্রাণও বেঁচে যাবে ! পৃথিবীর বুকে বোঝা হয়ে জন্ম নিবেনা আর কোনো অবাঞ্ছিত শিশু !

নিজে যদি নিজেকে সম্মান দিতে না পারেন, নিজেকে যদি জোরপূর্বক কোনো সম্পর্কে আটকে রাখেন, তাহলে কোনোদিনই নিজে সুখী হতে পারবেন না। আর নিজের পরিবারকেও সুখী করতে পারবেন না। সময় যাই হোক না কেনো, অসুস্থ বা তিক্ত সম্পর্কের ইতি টানুন। কারণ সবার জীবনেই একটা জিনিসের প্রয়োজন আছে, ভালোবাসা…

Leave a Reply