পেপসি এবং কোকাকোলা নিয়ে উদ্দেশ্যমূলক ‘ধর্মীয়’ মিথ্যাচার

কোমল পানীয় পেপসি এবং কোকাকোলা নিয়ে মিথ্যাচার করতে গিয়ে আমরা নিজেদের মূল্য কতটুকু কমিয়েছে, ভেবে দেখেছেন কখনো? হ্যাঁ, যেহেতু এটা তৃতীয় শ্রেণীর টপিক। তাই ব্যাপারটাকে পাত্তা না দেয়াই স্বাভাবিক।

গত কয়েকবছর যাবৎ পেপসি এবং কোকাকোলা নিয়ে নেতিবাচক অনেক কথা শুনেছি। ফেসবুকেও মানুষকে দেখেছি ঢালাওভাবে সচেতনতামূলক পোস্ট শেয়ার করতে। কেউ বলছে, কোক পেপসিতে নাকি শূকরের রক্ত মেশানো হয়। কেউ বলছে, মানুষের রক্তও মেশানো হয়। আবার কেউ কেউ রীতিমত ঘোষণা দিয়ে ফেলেছেন, পেপসি নাকি একটি ইসরাইলি প্রতিষ্ঠান ! তাই তারা পেপসি বর্জন করেছেন।

যতট‍ুকু মনে পড়ে, এই ইস্যুটার সময় বড় বড় কিছু ফেসবুক পেজে পেপসি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান PepsiCo কে ‘ইসরায়েলের সাহায্যকারী’ প্রতিষ্ঠান বলা হয়েছে। সেখানে PEPSI এর পূর্ণাঙ্গ রুপ হিসেবে দেখানো হয়েছে, Pay Each Penny to Save Israel !

অন্যদিকে Cola-Cola এর লোগো নিয়ে বলা হয়েছে, এটা উল্টো করে ধরলে যা আসে, তা আরবীতে পড়লে আল্লাহ পাক এবং মহানবী (সাঃ) কে অস্বীকৃতি জানানো হয়।

এরপরই শুরু হয় ব্যাপক হইহুল্লোড়। দেশের আনাচে কানাচে মসজিদ মাদ্রাসার হুজুররা বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে কোক পেপসির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান। তারপর যা হবার কথা, তার ফলাফল এখনো চলমান। রাস্তায় দাঁড়িয়ে পেপসি খাচ্ছি। পাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলো, ‘ভাই আপনি কি মুসলমান?’

এবার একটু ভেতরে যাওয়া যাক !

Pepsi ও Coca-Cola এর উৎপত্তি আমেরিকায়। পেপসির নামকরন করা হয় ১৮৯৮ সালে। তখন ইসরায়েল বাঁচানোর মতো কোনো ঘটনা বা প্রেক্ষাপট পৃথিবী দেখেনি। Pepsi নামটি এসেছে Pepsin নামক একটি এনজাইমের নাম থেকে, এটা ছিলো পেপসিতে ব্যবহার করা সেসময়কার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল। পেপসিন একটি গ্রিক শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে হজম করা।

১৯৬৬ সালে পেপসিকো (PepsiCo) যখন ইসরায়েলে তাদের শাখা খুলতে চেয়েছিলো, তখন মধ্যপ্রাচ্য ছিলো তাদের বড় একটি বাজার। ইসরায়েলে শাখা খুললে মধ্যপ্রাচ্যের ৪০টি দেশ তাদের বাণিজ্য বয়কট করতে চায়। তখন কোনো এক সুক্ষ বুদ্ধিওয়ালা আদমির মাথা থেকে Pepsi নামের ব্যাখ্যা হিসেবে আসে Pay Each Penny to Save Israel ! জনবিক্ষোভের মুখে একসময় তারা বাধ্য হয় ইসরায়েল থেকে ব্যবসায় সরিয়ে আনতে। আজ মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত পানীয়গুলোর মধ্যে মাক্কাকোলার পরেই পেপসির অবস্থান। উৎস ছাড়া এই নামটি আমাদের মুখে মুখে রয়ে যায়।

অন্যদিকে ১৮৮৬ সালে আমেরিকায় Coca-Cola প্রথম উৎপন্ন নেয়। কোকাকোলা তৈরির প্রথম উপাদান ছিল Cocaine আর Caffeine। কোকেন পাওয়া যায় Coca পাতা থেকে আর Caffeine পাওয়া যায় Kola Nut থেকে। সেই Kola থেকে Cola নাম এসেছে। কোকাকোলার মার্কেটিং ম্যানেজার ফ্রাঙ্ক রবিনসন (Frank Robinson) এ নামটি রাখেন। লোগো ডিজাইনটিও তিনিই তৈরি করেন। ফ্রাঙ্ক রবিনসন তার সারাজীবন আমেরিকায় কাটিয়েছেন। তিনি ছিলেন খুবই স্বল্পশিক্ষিত। আরবী জানার সম্ভাবনা তার মধ্যে নেই। আরবীকে উল্টো করে লিখে ইসলাম অবমাননা করতে হলেও সেজন্য প্রচুর জ্ঞানী এবং পন্ডিত টাইপের কাউকে প্রয়োজন। যেখানে আপনার আমার মত সাধারণ মানুষ আরবী হরফ চিনলেও উচ্চারণ করতে বারোটা বেজে যায়। অর্থ বোঝা তো দুরের কথা !

যাই হোক, ১৯৪৯ সালে কোকাকোলা ইসরায়েলে তাদের বোতল তৈরির ফ্যাক্টরি চাল‍ু করেছিলো। এ নিয়ে কূটনৈতিক কারণে মধ্যপ্রাচ্যে তখন কোকাকোলা বয়কট করা হয়।

পেপসি এবং কোকাকোলা নিয়ে ছড়ানো তথ্যটি যে একটি মিথ্যাচার, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট সহ আরো অনেক জার্নাল ঘেঁটে দেখেছি। বিষয়টির পক্ষে বিপক্ষে আলোচনাকারী বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে উপাত্ত জোগাড় করেছি। কোকাকোলা এর লোগোর ইতিহাস পড়ে দেখলাম, এট‍া আসলে উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়। লোগোটি যে বানিয়েছে, সেই ফ্রান্স রবিনসনের জীবনীও পড়লাম। ঘাঁটাঘাটি করতে গিয়ে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, পেপসি এবং কোকাকোলার যে অপবাদটা দেয়া হয়েছে, তার কোন শিকড়ই নেই। অনেকে এই মিথ্যাচারের পক্ষে লিখতে গিয়ে রেফারেন্স হিসেবে কিছু নিউজ লিংক দিয়েছে। লিংকে ঢুকলে দেখা যায়, সেখানে এরকম কিছুই বলা হয়নি। আর দুয়েকটা নিউজ লিংক পাওয়া যাবে, যেগুলো কোনো প্রতিষ্ঠিত নিউজ সাইট নয়। আমাদের দেশের অনলাইন নিউজপোর্টালগুলোর মত তৃতীয় শ্রেণীর ব্যক্তিগত সাইটগুলো থেকে এটা ছড়ানো হয়েছে। যার কোনো অথেন্টিসিটি বা ভেরিফাইড সোর্সই নেই ! আসলে, মিথ্যার কোনো শেঁকড় থাকেনা। শুধ‍ু অজস্র শাখা প্রশাখা থাকে ! প্রবাদটা ঠিকই ছিলো।

কিছু মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থে এভাবেই আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে মিথ্যাচার ছড়াচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে আমিও ইসরায়েল প্রতিষ্ঠাকে “অতিথিকর্তৃক জমি দখল” এবং আমেরিকার পুঁজিবাদকে “সাম্রাজ্যবাদের” সাথে তুলনা করি। কিন্তু অপরাধীর ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নেই না। এসব মিথ্যাচার আমাদের ধর্মকে ছোট করছে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে ‍মুসলমানরা পরিণত হচ্ছে হাসির পাত্রে !

যার ফল হিসেবে ইসলামিক তথ্যের ডাটাবেজ ‘উইকি ইসলাম’ নামক ওয়েবসাইটেও আজ Muslim Conspiracy Theories বা ‘মুসলমানদের বানানো চক্রান্ত’ নামক আর্টিকেল স্থান পায় !

তথ্যগুলোর সত্যতা পাওয়া যাবে নিচে উল্লেখিত সুত্রগুলোতে‍ঃ

  1. উইকি ইসলাম | WikiIslam
  2. পেপসিকো অফিসিয়াল ওয়েবসাইট | Pepsico.com
  3. কোকাকোলা অফিসিয়াল ওয়েবসাইট | Coca Cola
  4. উইকিপিডিয়া | Wikipedia
  5. ইউটিউব | YouTube
  6. Frank Mason Robinson এর জীবনী
  7. Soda Wars
  8. Encyclopedia Britannica 1992
  9. Chicago Tribune, May 19, 1992

Leave a Reply