লঞ্চ ডুবির ভয়? কিভাবে নিজেকে বাঁচাবেন?

একটি ফেরী আর একটি লঞ্চ একই নদীতে একই আবহাওয়ায় পাশাপাশি যাচ্ছে। নদীর স্রোত বেড়ে গেলে অথবা আবহাওয়া খারাপ হয়ে উঠলে কার ডোবার সম্ভবনা বেশি?

একটি জাহাজের (লঞ্চ, ফেরি, কার্গো জাহাজ, সামুদ্রিক জাহাজ) ভারসাম্য বা Stability বলতে আসলে কি বোঝায়?

আমরা খুব সহজেই ধরে নিতে পারি, ফেরীর ডোবার সম্ভবণা কম। কেননা আমরা তাই পর্যবেক্ষণ করে থাকি। কিন্তু কেনো ফেরী ডোবার সম্ভবণা কম? আমরা একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবো –

  • দেখেই মনে হয় ফেরী একটু ভারী লোহা দিয়ে তৈরী আর স্ট্রাকচারও বেশ মজবুত।
  • ফেরী লঞ্চ থেকে পাশে অনেক বড় (Beam) হয়।
  • ফেরী বড় বড় ঢেউয়েও খুব কম দোলাদুলি (Rolling/pitching/pounding) করে।
  • ফেরী যখন বড় কোন বাঁক নেয়, তখন সে খুব দ্রুত একদিকে হেলে পরেনা।
  • ফেরী পানির নিচের দিকে বেশ ফ্ল্যাট, লঞ্চের কিন্তু উল্টা পিরামিডের মত তলানী হয়।

পর্যবেক্ষণ করে তো এই তথ্যগুলো পেলাম। কিন্তু এতে ফেরী কি এমন এক্সট্রা সুবিধা পায়?

একটি জাহাজ (ফেরি, লঞ্চ, স্পীড বোট বা যেকোনো নৌযান) পানিতে কিভাবে আর কতক্ষণ ভাসবে, তা নির্ধারিত হয় তার ভারসাম্যতা বা Stabilty থেকে। সহজ কথায় কোনো জাহাজের যদি Stability ভালো হয়, তবে তা দীর্ঘক্ষণ খারাপ আবহাওয়াতে ভেসে থাকতে পারবে। তাহলে প্রশ্ন, এই Stability আবার কি বস্তু?

পানিতে কোনো কিছু ভেসে থাকলে তার উপর দুইটা এফেক্ট (বল) কাজ করে।

  • Weight (w)—নিচের দিকে সরল রেখা বরাবর কাজ করে, “G” কে কেন্দ্র করে
  • Buoyancy (B)—উপরের দিকে সরল রেখা বরাবর কাজ করে, “B” কে কেন্দ্র করে

ভাসমান কোনো কিছু শান্ত পানিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে প্রাথমিক অবস্থায় এই দুইটি বল একই লাইন বরাবর থাকে। কিন্তু যদি কাঁত হয়ে যায়, তখন? কোন বস্তুর center of gravity (G) কাঁত অবস্থায়ও একই থাকে। কিন্তু center of buoyancy (B) যেদিকে কাঁত হবে, সেই দিকে সরে যাবে। অর্থাৎ কাঁত অবস্থায় “G” এবং “B” একই লাইন বরাবর কাজ করবে না। সোজা থাকা অবস্থায় “G” আর “B” এর লাইনে নতুন “B” এর লাইন যেখানে ছেদ করবে, সেই বিন্দুকে আমরা বলব ‘M”। “G” থেকে “M” পর্যন্ত দূরত্বকে বলা হয় “GM”। সমস্ত খেলা চলবে এই “GM” কে নিয়ে ! অর্থাৎ একটি ভাসমান বস্তু (বা জাহাজ) ভাসমান থাকতে পারবে কিনা, তার নির্ধায়ক হবে এই “GM” কত বড় বা ছোট সেটার উপর। বড় “GM” মানে বেঁচে গেলাম, জাহাজ সহজে ডুববে না, আর ছোট “GM” এ ভরসা নাই, এই ডুবলো কি সেই ডুবলো ! আরো খারাপ ব্যাপার ঘটবে তখন, যখন “G” ভাইজান কোন কারণে “M” ভাইজানের উপরে উঠে গেলে। তখন এই অবস্থাকে আমরা বলি ঋণাত্বক “GM” (Negative “GM”)। ডোবার সম্ভবনা তখন অনেক বেশি বেড়ে যাবে। ঋণাত্বক “GM” নিয়ে রওয়ানা দিয়ে খারাপ আবহাওয়ায় কোন স্রোতে বা বড় ঢেউয়ে পড়লে, বা তীব্র বাতাসে পড়লে তখন আল্লাহর নাম নেয়া ছাড়া আর কোন গতি নেই (গতি হতে পারে যদি লঞ্চ কোম্পানি দয়া করে যাত্রী সমপরিমাণ লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থা রাখে ও সবাইকে যাত্রাকালীন সময়ে তা পড়তে বাধ্য করে, বা জীবন বাঁচানোর অন্যান্য ব্যবস্থা রাখে, যেমনঃ লাইফ র্যােফট, লাইফ বোট ইত্যাদি। তবে বাংলাদেশে এই আশা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে!)।

তাহলে আমাদের উপায়? বাঁচার কি কোন রাস্তাই নেই? লঞ্চ বাদ দিয়ে ফেরীতে উঠবো? এত পড়াশোনা করে তারপর লঞ্চে উঠতে হবে? ঈদে বাড়ি তাহলে আর যাওয়া হল না? হবে। অবশ্যই হবে। সাধারণ যাত্রী ভাইদের কিছু টিপস দিয়ে লেখা শেষ করতে চাই…

নদীপথে যাত্রার কিছু টিপস

কিভাবে বুঝবেন, এই লঞ্চের stability ঠিক আছে কিনা? লঞ্চে উঠার আগে আর পরে অল্প মাথা ঘামিয়ে GM/Negative GM বের করে ফেলা যায়, যদিও পুরোপুরি নয়, তারপরও জীবন বাঁচাতে বেশ কাজে লাগবে। আমরা ধরেই নিচ্ছি আমাদের আমলা তন্ত্রের জটিলতায় কোনো শুভ কাজ হয় না, হবেও না। তাই নিজের জীবন বাঁচাতে আসুন জেনে নেই কিছু মহার্ঘ্য টিপস !

  • অবশ্যই over crowded লঞ্চে ভুলেও পা দেবেন না। কেনো দেবেন না, তা আরো একটু পর ভালো ভবেই বুঝতে পারবেন।
  • একটু মোটাতাজা স্বাস্থ্যবান শক্তিশালী লঞ্চ বেছে নিন।
  • যে লঞ্চটার পাশে বড় (Beam) অর্থাৎ প্রশস্ত, সেটা বেছে নিন।
  • যে লঞ্চটার নিচের দিকটা ফ্ল্যাট বা মোটামুটি ফ্ল্যাট সেটা বেছে নিন।
  • উচ্চতা কম (অর্থাৎ “তলা” কম) এমন লঞ্চ বেছে নিন, আগেই বলেছি “GM” ভাইজান ছোট হলে আর রক্ষা নেই, লঞ্চের পাশে বড় না হয়ে উপরে বড় হলে বেচারা “M” যায়গা মতই থাকবে, তবে “G” ফুড়ুৎ করে সোজা উপরে উঠে পরবে। তাতে কি হবে? এইতো বুঝতে পেরেছেন, “GM” মহাশয় যথেষ্টই ছোট হয়ে যাবে। ছোট “GM” এর বিপদ তো বলেছিই। আর কোনো কারণে “G” আরো উপরে উঠে ঋণাত্বক হয়ে গেলে তো কথাই নেই। অতিরিক্ত যাত্রী কিন্তু “G” কে ঋণাত্বক করতে বেশ বড় ভূমিকা রাখে !
  • লঞ্চ কর্ত্তৃপক্ষ লাইফ জ্যাকেট না দিলে আপনিই বরং কিনে নিন ! বুঝতে পারলেন তো, দেখতে সুন্দর হলেও ৩/৪/৫ তলা লঞ্চ অতটা নিরাপদ নয়।
  • “G” আবার একটু নরম সরম। ধরুন কোনো লঞ্চে আপনারা ২০০ জন উঠলেন। সবাই ঠিক করলেন ছাদে যেয়ে একটু আমোদ ফূর্তি করবেন! তাতে আপনাদের আনন্দ বাড়ার সাথে সাথে “G” ভাইজানও আপনাদের হাত ধরে উপরে উঠে যাবে। আর “G” উপরে উঠার বিপদ? আগেই বলেছি “G” যত উপরে উঠবে, “GM” তত ছোট হবে। এখন যদি বড় কোনো ঢেউ বা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া বাতাসের বেগ আপনাদের লঞ্চটাকে কাঁত করে দেয়, তখন দয়া করে লঞ্চ মালিক অথবা উপরওয়ালাকে দোষ দেয়ার আগে নিজেকে দোষ দিয়ে যাবেন। পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে “G” সর্বদাই যেদিকে ওজন বাড়বে, সেদিকেই ধাবিত হবে। তাই আপনারা আপনাদের ওজনের সাথে সাথে “G” কেও কিন্তু উপরে নিয়ে যাচ্ছেন !
  • নদীতে ঢেউ দেখতে পেলে একটু ত্যাগ স্বীকার করে লঞ্চের একেবারে নিচে চলে আসুন। হ্যাঁ, আপনাদের সাথে সাথে “G” ও যেহেতু নিচে নেমে যাবে, তাতে “GM” বৃদ্ধি পেয়ে লঞ্চটাকে বেশ ভারসাম্যময় (stable) করে ফেলবে। আপনারাও সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ দেবার সুযোগ পেয়ে যেতে পারেন !
  • মৃত্যুর সাথে প্রতিযোগিতা ! হ্যা‍ঁ, ঠিক শুনেছেন। আপনারা মাঝে মাঝেই এমন অসম প্রতিযোগিতায় জেনে বা না জেনে নেমে পড়ছেন। মনে করে দেখুন দুটি বাস বা গাড়ি বা লঞ্চ প্রতিযোগিতা করছে কে কার আগে যাবে। মৃত্যুর তোয়াক্কা না করে অনেক সময়ই আমরা ড্রাইভারদের উৎসাহ দেই। লঞ্চের ক্ষেত্রেও তাই। মৃত্যুর সাথে দুষ্টুমি আপনি একা একা করুন, সাথে আরো কিছু প্রাণের সাথে এই খেলা না খেললেই কি নয়?
  • “ওই দেখো দেখো!” কে যেনো বলল, ব্যস ! বাকি সবাই ছুটলাম সেটা দেখতে। মনোরম দৃশ্য দেখতে যেয়ে সবাই যদি একপাশে চলে যান, তাতে সেই “G” কেও কিন্তু সাথে করে ওইপাশে নিয়ে যাচ্ছেন। তাতে লঞ্চটি ওই পাশে বিপজ্জনক ভাবে হেলে পড়তে পারে। আর জানেনই তো, বাংলাদেশের লঞ্চগুলোতে stability-এর জন্মগত সমস্যা আছে, আমাদের “যথাযথ কর্ত্তৃপক্ষ” বিনা ইন্সপেকশনেই “যথাযথ সার্টিফিকেট” ইস্যুও নবায়ন করে থাকে। (তাই নিজের জীবন বাঁচাতে আমাদেরই সতর্ক থাকা বেশী জরুরী!) আপনারা একপাশে সবাই মিলে “ওই দেখো, ওই দেখো” করছেন, আর ঐ মূহুর্তে মৃত্যুদূত সাথে করে নিয়ে এল বিশাল বিশাল ঢেউ ! রক্ষা নেই! Deck edge immersion বলে একটা ব্যাপার আছে। কাঁত হতে হতে একসময় লঞ্চের ফাঁকফোকর দিয়ে পানি উঠা শুরু হবে, আর পানি শুধু ঢুকেই শান্ত হবে না, free surface effect নামে আরো এক ভয়ংকর ব্যাপার হাজির হবে ! Free surface effect এর ফলে “GM” এর virtual loss হয়, অর্থাৎ সেই “GM” মহাশয় আবারো ছোট হয়ে যায়। তাই আবারো বলছি, “GM” ছোট হলে কিন্তু বেশ বিপদ আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে!
  • এখানে আরো একটা বিপদ আছে। ধরুন একপাশে কাঁত হয়ে গেল, ব্যস শুরু করে দিলেন দৌড় প্রতিযোগিতা, ঐ পাশে চলে যাবার জন্য সবাই একসাথে দৌড় লাগালেন। কি হবে জানেন? “G” যেহেতু আপনাদের সাথে সাথে দৌড় দেবে, ওপাশটাও কাঁত হয়ে যাবে। অর্থাৎ rolling effect কে বাড়িয়ে দিলেন। লঞ্চের প্রাথমিক “GM” (initial GM) যেহেতু ছোট, আপনারা দৌড়াদৌড়ির ফলে লঞ্চটাকে আরো unstable (ভারসাম্যহীন) করে ফেলছেন নিজেদের অজান্তে। প্লিজ, দৌড়ের ব্যাপারটা মাঠেই সীমাবদ্ধ থাকুক, অন্য কোথাও নয়!
  • আচ্ছা, লঞ্চে উঠেই পড়েছেন। অন্য কিছু ভাবার বা দেখার অবকাশ হয়নি। এখন যদি একটু খেয়াল করি, তাহলে কিন্তু লঞ্চটার “GM” কেমন তা খুব সহজেই অনুমান করা যায়! ধরুন লঞ্চটা চলা শুরু করেছে, খেয়াল করে দেখুন, লঞ্চটা কেমন বিহেভ করছে। যদি দেখেন, লঞ্চটা অল্পতেই কাঁত হয়ে যাচ্ছে, আর এ কাঁত থেকে ও কাঁত হচ্ছে বেশ ধীর লয়ে। তাহলে নিশ্চিত এই লঞ্চ সাহেবের “GM” ঘটিত সমস্যা আছে। এই অবস্থাকে আমরা বলি tender ship ! আর যদি দেখেন এ কাঁত থেকে ও কাঁত কম হচ্ছে, আর হলেও বেশ দ্রুত, এইতো চাই, এই লঞ্চটি বেশ stable (ভারসাম্যময়)। বড় “GM” থাকলে ওই অবস্থাকে আমরা বলি stiff ship (শক্ত জাহাজ)। অর্থাৎ অল্পতেই কাঁত হয়ে যায়, এবং ধীরে ধীরে তার আগের অবস্থায় ফিরে আসে, এমন tender ship এ উঠে আপনার জীবনের ঝুকি নিতে চাচ্ছেন কিনা, আর তা যদি হয় বর্ষাকালে বা খারাপ আবহাওয়ায়, তা একবার ভেবে দেখুন। টিকিটের টাকা যদি ফেরত নাও পাওয়া যায়, দয়া করে লঞ্চ মাস্টারকে বলুন লঞ্চ থামিয়ে আপনাকে নামিয়ে দিতে। আমি নিশ্চিত, আপনার মত সচেতন চার পাঁচজন থাকলে বাকি সবার ভ্রমণও নিরাপদ হয়ে উঠবে।

লঞ্চ ডুবি এড়াতে আসুন সতর্ক হই

হতে পারে আপনি আশাবাদী মানুষ (এবং চিত্রনায়ক অনন্ত জলিলের মত অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন), সরকারের উপরে বেশ আস্থা রাখেন, এবং ধরে নিচ্ছেন তদন্ত কমিটি সঠিক রিপোর্ট দিবে, এবং সরকার সেই অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেবে, তাহলে আপনাকে এত কিছু চিন্তা না করলেও চলবে। আর যদি আমজনতার মত করে চিন্তা করেন, তাহলে উপরের মত করে সব কিছু করবেন, এমন আশা করতেই পারি।

আরেকটা ব্যাপার, আপনি এত কিছু করতে চাইছেন না, আর আপনার পকেটে খরচ করার মত অতিরিক্ত কিছু টাকা আছে, তাহলে চলে যান কোনো খেলনা সামগ্রী বেচাকেনার দোকানে। কিনে ফেলুন আপনার ও আপনার সঙ্গীদের জন্য লাইফ জ্যাকেট। লঞ্চে উঠার সময় অথবা প্রতিকুল আবহাওয়া দেখলে জ্যাকেটটা অবশ্যই পড়ে নিবেন। পারলে যাত্রার পুরো সময়টাতেই লাইফ জ্যাকেট পরে থাকতে পারেন। অন্যরা হয়ত মুখ টিপে হাসবে, তবে লঞ্চ ডোবার পর আপনার জন্য শেষ হাসি অপেক্ষা করছে, তা প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়…

আমরা চাইলেই এই নতুন নিয়মটার সূচনা করতে পারি !

Leave a Reply