ইতিহাসের কুখ্যাত খুনি !

খুন ! খুন শব্দটা মানুষ এতটাই ঘৃনা করে যে তার সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে মৃত্যুদন্ড। পৃথিবীতে প্রথম খুন করেছিলেন কাবিল। এরপর থেকে নাম না জানা কত মানুষ কত মানুষকে খুন করলো, তার কি আর কোনো হিসাব আছে? নাহ নেই। আমাদের কাছে নেই, স্রষ্টার কাছে আছে…

তবে খুন করে সবাই খুনি উপাধি পেলেও কেউ কেউ এই “খুনি” শব্দটিকে একটা আলাদা তকমা লাগিয়ে দিয়েছে। আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সেটা খারাপ হলেও তার দৃষ্টিকোণ থেকে সেটা রীতিমত গৌরবের বিষয়। খুনিরা যখন তাদের খুনের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন তাদের বলা হয় সিরিয়াল কিলার। একজন সাধারণ খুনি যখন একজন পেশাদার খুনি হন বা সিরিয়াল কিলার হন, তখন তার কাছে খুন করাটা তার ধ্যান, জ্ঞান। খুনকে সে বানিয়ে ফেলে একটা শিল্প। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অনেক সিরিয়াল কিলার জন্ম নেয়। অনেক ক্ষেত্রে সে পৃথিবীর মানুষের নজরে চলে আসে, অনেক ক্ষেত্রে আসেনা। তবে কিছু ব্যাক্তি আছেন যারা খুনকে পেশা হিসেবে নিয়ে বনে গেছেন সিরিয়াল কিলার উপাধির ভাগীদার। চলুন ইতিহাসের সেই কুখ্যাত খুনিদের কয়েকজনের বিবরণ জেনে নেয়া যাক…

ইতিহাসের কুখ্যাত খুনি !

লুইস গারাভিতো : পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত খুনি এই লুইস গারাভিতো। সন্দেহ করা হয় সে প্রায় ৪০০ জনের উপরে মানুষ খুন করেছিল। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণ হয়েছিল ১৩৮ জনের খুনের অপরাধ। গারাভিতোর খুনের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল পথশিশু।

Luis Garavito

১৯৫৭ সালের ২৫শে জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করে এই কুখ্যাত খুনি এবং ১৯৯০ সালেই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বেশি খুন সম্পন্ন করেন। কলম্বিয়া আইন অনুযায়ী তাঁর সর্বচ্চ ৩০ বছরের সাজা হয়। পরবর্তীতে লাশ শনাক্ত করতে পুলিশকে সহায়তা করার জন্য তাঁর সাজা কমিয়ে ২২ বছর করে দেয়া হয়। তাঁর এই সাজায় সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে উত্তেজনা ছড়িয়ে পরে। কলম্বিয়ার জনগণ তাঁর জন্য আলাদা প্রসিকেউশন গঠন করার দাবি জানায়। কলম্বিয়াতে লুইস গারাভিতো “La Bestia” (পশু) নামে পরিচিত।

জ্যাক দ্য রিপার : ইতিহাসের অন্যতম ভয়ঙ্কর সিরিয়াল কিলার বলা হয় তাকে। ১৮৮৮ সাল থেকে ১৮৯১ সাল পর্যন্ত পূর্ব-লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেলের আশপাশ জুড়ে সর্বমোট এগারোটি খুনের ঘটনা ঘটিয়ে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার জ্যাক দ্য রিপার। তার কোনো ছবি তো দূরে থাকুক, জ্যাক দ্য রিপার নামে কখনো কোনো লোক ছিল কিনা, এ সম্পর্কেও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

Jack the Ripper

Jack the Ripper

এই খুনগুলো যখন লন্ডনজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা আর আতঙ্কের ঝড় বইয়ে দিল, তখন এসব খুনের দায়-দায়িত্ব স্বীকার করে জ্যাক দ্য রিপারের স্বাক্ষরযুক্ত একটি চিঠি পাঠানো হয়েছিল লন্ডনের সেন্ট্রাল নিউজ এজেন্সির কাছে। মূলত এরপর থেকেই মিডিয়ার কাছে ব্যাপক পরিচিতি পায় জ্যাক দ্য রিপার নামটি। এ ঘটনার আগেও অনেক সিরিয়াল কিলারের অস্তিত্ব ছিল ইতিহাসে। কিন্তু এ নামটির মত আতঙ্ক এর আগে কেউ ছড়াতে পারেনি। তারচেয়েও বড় বিষয় এই খুনি ছিল সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে।

তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি কখনোই। ম্যালভিল ম্যাকনাগটেন নামের তৎকালীন চিফ কনস্টেবল জ্যাক দ্য রিপার হিসেবে তিনজন ব্যক্তিকে সন্দেহ করেন। এরমধ্যে প্রধান হলেন এম জে ডরুয়িট নামে এক ব্যারিস্টার যিনি পরবর্তীতে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন। দ্বিতীয়জন এরন কসমিনিস্কি নামের এক পোলিশ ইহুদি এবং তৃতীয়জন মাইকেল ওস্ট্রং নামের একজন উন্মাদ লোক। তবে এর সপক্ষে কোনো জোরালো প্রমাণ ছিল না। ডিটেকটিভ ফেডারিক এভারলিন জ্যাক দ্য রিপার হিসেবে সন্দেহ করেন সেভেরাইন ক্লোসোস্কি এলিস জিওর্গি চেপম্যানকে।

এটিও প্রমাণ করা যায়নি। এছাড়া আরও কয়েকজন ব্যক্তিকে জ্যাক দ্য রিপার হিসেবে সন্দেহ করা হলেও এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি কে এই জ্যাক দ্য রিপার ! গত প্রায় ১২০ বছর ধরে জ্যাক দ্য রিপার ও তার হত্যাকাণ্ড গুলোকে ঘিরে রচিত হয়েছে অজস্র গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা এমনকি ভিডিও গেমস। শুধু তাই নয়, জ্যাক দ্য রিপার যেসব স্থানে হত্যাকাণ্ড গুলো ঘটিয়েছিল, সেসব স্থান দেখার জন্য সারা বিশ্ব থেকেই মানুষজন আসেন পূর্ব-লন্ডনে।

জ্যাক দ্য রিপার যাদের হত্যা করেছেন, তাদের বেশিরভাগই ছিল পতিতা। জ্যাক দ্য রিপার যৌন কার্যের সময় ভিকটিমকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করত। রিপার উইচপেল খুনি এবং লেদার অ্যাপ্রন নামে পরিচিত। জ্যাক দ্য রিপার সত্যিকার অর্থে কত জন খুন করেছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

পেদ্রো লোপেজ : পেদ্রো লোপেজ হল কলম্বিয়ান কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার। তাঁর প্রকৃত খুনের হিসাব আজ পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে তাকে ৮০ জন মেয়ের প্রাণনাশ করার দায়ে সাজা দেয়া হলেও ধারনা করা হয় প্রায় ৩০০ এর মত মেয়ের সাথে যৌন নির্যাতন এবং পরবর্তীতে তাঁদের নৃশংসভাবে হত্যা করে এই কুখ্যাত খুনি। সে সর্বপ্রথম মিডিয়াতে আলোচিত হয় ১৯৮০ সালের ৯ মার্চ।

Pedro Alonso López

Pedro Alonso López

অনেকের মতে সে ধর্ষণের পর ভিক্টিমকে জবাই করত তারপর তাঁর রক্ত দিয়ে হাত ধুতো। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এবং তাঁর ১৬ বছরের কারাদণ্ড হয়। জেলখানায় ভাল ব্যবহার করার ফলে তাঁর ২ বছরের সাজা মওকুফ করে দেয়া হয়।

রিচার্ড ট্রেনটন সেচ : রিচার্ড সেচ হল আমেরিকান সিরিয়াল কিলার। এই সিরিয়াল কিলার এর জন্ম ১৯৫০ সালে। তার নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলোর জন্য তাকে “ভেম্পায়ার অব স্ক্যারামেন্ট” নামেও অবিহিত করা হত। রিচার্ড তার প্রথম শিকার করে ৫১ বছর বয়সী ইঞ্জিনীয়ার এমব্রোস গ্রিফিন নামক ব্যক্তিকে। তার দ্বিতীয় শিকার টেরেসা ওয়ালিন ছিল অন্তঃসত্ত্বা। তাকে হত্যার পর তার সাথে মিলিত হয় এবং তার রক্ত দিয়ে গোসল করে। ১৯৮০ সালের ৮ মে বিচারে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। কারাগারে অপেক্ষাকালীন সময় ১৯৮০ সালের ২৬শে ডিসেম্বর সেলে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ধারনা করা হয়, প্রিজন ডাক্তার এর ঔষধ অতিরিক্ত খেয়ে সে আত্মহত্যা করে। ধারণা করা হয়,মৃত্যুর আগ পর‍্যন্ত সে ১২০ জনের অধিক মানুষ হত্যা করছেন।

জেফরি ডামার : জেফরি ডামার হল একজন মার্কিন মানুষখেকো খুনি। জেফরির জন্ম ১৯৬০ সালে। ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ১৭টি নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ডামার তার শিকারকে জোরপূর্বক সমকামিতায় বাধ্য করাসহ তাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে সেই মাংস ভক্ষণ করত।

Jeffrey Dahmer

১৯৮০ সালে ১৩ বছরের এক বালককে হয়রানির জন্য তাকে ১ বছরের সাজা দেয়া হলে সে বিচারকের কাছে সব দোষ স্বীকার করে এবং তাকে মেন্টাল থেরাপি দেয়ার অনুরধ করে। ১৯৯১ সালে সালের ডিসেম্বরে ডামার পুনরায় পুলিশের কাছে ধরা পরলে তার কুকীর্তিগুলো প্রকাশিত হয়ে পরে। বিচারে তার ৯৩৭ বছরের জেল হয়।  বিচারকালে ডামার তার কারাবাসের পরিবর্তে নিজের মৃত্যুদণ্ডের দাবি করে। ১৯৯৪ সালের ২৮ নভেম্বর কারাগারের জিমে কর্মরত অবস্থায় ক্রিস্টোফার স্কেভার নামক আরেক কয়েদির মারাত্মক পিটুনিতে নিহত হয়।

জাভেদ ইকবাল মুঘল : তার পুরো নাম জাভেদ ইকবাল মুঘল। ১৯৫৬ সালের ৮ অক্টোবর পাকিস্তানে জন্ম নেয়া এই লোকটিকে উপমহাদেশের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সিরিয়াল কিলার মানা হয়। তার হাতে প্রায় ১০০ শিশুর নৃশংস মৃত্যু হয়েছিল। প্রায় প্রতিটি মৃত্যুর সঙ্গেই যৌন নিপীড়নের যোগসূত্র ছিল। জাভেদের মানুষ হত্যার ক্ষেত্রে বিকৃত রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯৯৮ সালে জাভেদের বিষয়টি প্রথমবারের মতো সবার সামনে আসে। অবশ্য তখন এমন ভয়াবহতার কথা কেউ কখনো কল্পনা করেনি। সেবার ২ জন বালককে যৌন হয়রানির জন্য জাভেদকে আটক করে পুলিশ।

Javed Iqbal Mughal

Javed Iqbal Mughal

কিন্তু আইনের ফাঁক গলে ঠিক বেরিয়ে যায় সে। আর সে সঙ্গে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে জাভেদ। শুরু করে তার কুকর্ম। জাভেদ ছিল মিশুক প্রকৃতির। মিষ্টি মধুর কথা আর সুন্দর ব্যবহার দিয়ে খুব সহজেই মানুষের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলত। আর সম্পর্ক তৈরি হওয়ার পরই স্বরূপে আবির্ভূত হতো সে। সুযোগ বুঝে প্রথমে ধর্ষণ ও পরে ছুরিকাঘাত করে তাদের হত্যা করত। জাভেদের নৃশংসতার এখানেই শেষ ছিল না। হত্যার পর জাভেদ মৃতদেহগুলোকে টুকরো টুকরো করে ফেলত। আর দেহের খণ্ডাংশগুলো কোথাও ফেলে না দিয়ে হাইড্রোলিক এসিডভর্তি ড্রামে ডুবিয়ে রাখত। এতে করে অল্প সময়ের মধ্যেই দেহের খণ্ডাংশগুলো গলে যেত। তখন সেই গলিত দেহাবশেষের তরল স্যুয়ারেজ লাইন কিংবা নদীতে ফেলে দিত।

একসময় জাভেদের বাড়িতে পুলিশ রিপোর্টাররা এসে ভয়ঙ্কর চিত্র আবিষ্কার করে। জাভেদের ভিকটিমের ব্যবহৃত ব্যাগ ও জুতা এবং অনেকগুলো ছবি পাওয়া যায়। এসিডের বোতল ছাড়াও ছুরি এবং আরও রক্তাক্ত জিনিস পাওয়া যায়। তার ঘরের দেয়াল ও মেঝেতে রক্তের দাগ পাওয়া যায়। পুলিশের কাছে ধরা খাওয়ার পর জাভেদ নিজেই গড়গড় করে তার সব অপরাধের বৃত্তান্ত তুলে ধরে। জাভেদের ভাষায়, ‘আমি চাইলে ৫০০ বালককে হত্যা করতে পারতাম। আমি জাভেদ ইকবাল, ১০০ শিশুর হত্যাকারী। আমি এই পৃথিবীকে ঘৃণা করি এবং আমি আমার কাজের জন্য লজ্জিত নই। আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত, আমার কোনো অনুশোচনা নেই যে, আমি ১০০ শিশুকে হত্যা করেছি।’ হত্যার আগে সব শিশুকে যৌন নিগৃহ করেছে বলে তার লিখিত ডায়েরিতে উল্লেখ করেছে জাভেদ। বিচারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় হয়। বিচারক তার রায়ে বলেন, যদিও তাকে ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে কিন্তু আমি চাই তাকে ১০০ বার ছুরিকাহত করে হত্যা করতে এবং ১০০ টুকরো করে এসিডে ডুবিয়ে রাখতে। তার ফাঁসি কার্যকর করার আগে ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর প্রিজন সেলে তাকে ছুরিকাহত হয়ে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কর্তৃপক্ষ জানায়, জাভেদ প্রিজন সেলে আত্মহত্যা করেছে।

ফুলন দেবী : তার পরিচিতি দস্যুরানী হিসেবে। কুখ্যাত খুনির তালিকায় তার নামটা না এলেও পারত। কারণ প্রথম জীবনের বঞ্চনা এবং পরের জীবনের বিদ্রোহ তার প্রতি মানুষের একটা সহমর্মিতা তৈরি করেছে। এরপরও কেবল প্রতিশোধের নেশায় একের পর এক মানুষ হত্যা দস্যুরানী ফুলন দেবীকে ইতিহাসের অন্যতম খুনি হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে। তার জন্ম ১৯৬৩ সালে ভারতের এক নিচু পরিবারে। দারিদ্র্য এবং সামাজিক কারণে জীবনের শুরু থেকেই সংগ্রামের মুখোমুখি হয় ফুলন। মাত্র এগারো বছর বয়সে বাবার বয়সী এক লোকের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। ফুলনের গ্রাম এবং আশপাশের একাধিক গ্রামে ঠাকুর বংশের জমিদারী ছিল। আর জমিদারের লোকরা প্রায়ই গ্রামের দরিদ্র গ্রামবাসীর কাছ থেকে ফসল নিয়ে নিত এবং তাদের ওপর নির্যাতন চালাত।

Phoolan Devi

Phoolan Devi

ফুলন এসবের প্রতিবাদ জানিয়ে দখলকারীদের নেতা মায়াদীনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে। এ অপমানের প্রতিশোধ নিতে ঠাকুররা তাকে ধরে নিয়ে যায় বেমাই নামে প্রত্যন্ত এক গ্রামে। এরপর তার ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। দুই সপ্তাহ ধরে প্রতি রাতে ঠাকুর ও তার লোকরা ফুলনকে গণধর্ষণ করে। প্রতি রাতেই ফুলন জ্ঞান না হারানো পর্যন্ত চলত এ পাশবিকতা। ১৬ দিনের মাথায় এক রাতে নির্যাতন শেষে তারা ফুলনকে মৃত মনে করে ফেলে রাখে। আর প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী ফুলন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। তখন ফুলনের বয়স ছিল মাত্র সতেরো। পালিয়েও রক্ষা পেলেন না ফুলন। আরেকবার ধরা পড়লেন এক দস্যু দলের হাতে। দস্যুদের নেতা বাবুর নজর পড়ে ফুলনের ওপর। সে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল ফুলনের ওপর। কিন্তু আরেক দস্যু এতে বাধা হয়ে দাঁড়াল। বাবুকে খুন করে ফুলনকে রক্ষা করে সে। এরপর ফুলনের সঙ্গে বিক্রমের বিয়ে হয় এবং শুরু হয় ফুলনের নতুন জীবন। রাইফেল চালানো শিখে পুরোদস্তুর দস্যু হয়ে ওঠে। ফুলন তার আলাদা বাহিনী নিয়ে প্রথম হামলা চালায় তার সাবেক স্বামীর গ্রামে। নিজ হাতে ছুরিকাঘাতে তার স্বামীকে খুন করে রাস্তায় ফেলে রাখে।

ফুলন তার সংগঠিত দস্যুদল নিয়ে ক্রমাগত ধনী গ্রাম এবং জমিদার বাড়িগুলোতে আক্রমণ চালাতে থাকে। এর মধ্যেই একদিন ধনী ঠাকুর বংশের ছেলের বিয়েতে সদলবলে ডাকাতি করতে যায় ফুলন। সেখানে ফুলন খুঁজে পান এমন দু’জন মানুষকে, যারা তাকে ধর্ষণ করেছিল। ক্রোধে উত্ত ফুলনদেবী আদেশ করে বাকি ধর্ষণকারীদেরও ধরে আনার। কিন্তু বাকিদের পাওয়া না যাওয়ায় লাইন ধরে ঠাকুর বংশের বাইশজনকে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলা হয়। বেমাইয়ের এই গণহত্যা ভারতবর্ষে ব্যাপক সাড়া ফেলে। সরকার ফুলনকে ধরার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে।

আবার ফুলনের পক্ষেও আন্দোলন হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার সন্ধিপ্রস্তাব করলে ফুলন অনেকগুলো শর্ত দেন। সরকার সেই শর্ত মেনে নিলে ১০,০০০ মানুষ আর ৩০০ পুলিশের সামনে ফুলনদেবী অস্ত্র জমা দেন গান্ধী আর দুর্গার ছবির সামনে। ১১ বছর কারাভোগের পর ফুলন সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ এবং ৯৯ -তে পরপর দুইবার লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের ২৫ জুলাই ঠাকুর বংশের তিন ছেলের এলোপাতাড়ি গুলিতে ফুলন দেবী নিহত হন।

বাংলাদেশি সিরিয়াল কিলার

এবার এমন এক সিরিয়াল কিলারের কথা বলবো, যে সিরিয়াল কিলিং করে সিরিয়াল কিলারের লিস্টে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তিনি বাংলাদেশ এর এক সিরিয়াল কিলার। বিশ্বের কুখ্যাত সিরিয়াল কিলারের লিস্টে তিনিও আছেন।

‍বাংলাদেশের অপরাধীদের মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত নামটি হলো এরশাদ শিকদার ! নৃশংসতা ও ভয়াবহতার দিক থেকে এরশাদ শিকদার সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তার জন্ম ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মাদারঘোনা গ্রামে। ১৯৬৬-৬৭ সালে খুলনায় আসার পর আস্তে আস্তে সেখানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। পেশায় প্রথম দিকে কুলির সহযোগী ছিল সে। পরবর্তী সময়ে চুরি-ডাকাতির সঙ্গে জড়িয়ে একসময় রাঙ্গা চোরা নামে পরিচিতি পায়। এরপর জড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ কিলিং মিশনের সঙ্গে। এরশাদ শিকদার যাকে পথের কাঁটা মনে করেছে, তাকে হত্যা করেছে। রাজসাক্ষী নূরে আলমের মতে, এরশাদ শিকদার কমপক্ষে ৬০টি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তবে সে ২৪টি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছিল। এরশাদ শিকদারের ছয়টি বিয়ের কথা জানা গেছে। এরশাদ শিকদারের হাতে বহু নারী নির্যাতিত-লাঞ্ছিত হয়েছে। যাকে তার পছন্দ হত, তাকেই সে ছলে-বলে-কৌশলে তার ডেরায় নিয়ে এসে নির্যাতন করত। ১৯৯৯ সালে গ্রেফতার হওয়ার সময় তার নামে তিনটি মামলা ছিল। পরে এরশাদের নামে আরও ৪৩টি মামলা হয়। নিম্ন আদালতের বিচারে সাতটি হত্যা মামলায় তার ফাঁসির দণ্ডাদেশ হয়। চারটি মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয়। ২০০৪ সালের ১০ মে মধ্যরাতে খুলনা জেলা কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়।

এভাবেই তারা আজ সিরিয়াল কিলার উপাধি পেয়েছেন। তারা নন্দিত নন, কিংবা বিখ্যাত নন। তারা মানুষের চোখে একটা অভিশপ্ত কীট। যদিও উপরের সিরিয়াল কিলারদের মধ্যে একমাত্র ফুলন দেবী সমাজের কাছে চরমতর ধাক্কা খেয়ে নিজেকে সিরিয়াল কিলার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করিয়েছিলেন। তবে পৃথিবীর অধিকাংশ সিরিয়াল কিলাররা হয়ে থাকেন মানসিকভাবে কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির। যাদের বলে সাইকোপ্যাথ ! তবে এটাও সবার মনে রাখা উচিত একটি সমাজ একটি সিরিয়াল কিলারের জন্মদাতা হতে পারে ! আবার কেউ সিরিয়াল কিলার হয় নিজ ইচ্ছায় ! মানুষ, সমাজ বড় বিচিত্র…

Leave a Reply