অনুভূতিহীন কপোট্রনিক

একাকীত্ব খুব ভয়ানক। একাকীত্বের সময়গুলো সবার ক্ষেত্রেই কমবেশ একই রকম। সকালবেলা মুঠোফোনে কারো খুদে বার্তা পাবার অপেক্ষা থেকে শুরু হয় এই একাকীত্ব। এরপর সবার মাঝে থেকেও ’কিছু যেনো নাই’ বা ’কি যেনো হারিয়ে গেছে’ এমন বোধ করার নামটাও একাকীত্ব।

খাবারে অরুচি বা বেশি খেয়ে ফেলা, অতিরিক্ত কথা বলতে চাওয়া, বারবার সেই মানুষটিকে কল্পনা করে তার সাথে কথা বলা; মাথায় বিভিন্ন প্লট সাজানো তাকে নিয়ে, এসব বাড়তে বাড়তে পড়ন্ত বিকেলে একটু ঝিমিয়ে নেয়া বা ঘুমিয়ে পরা; এরপর সন্ধ্যা থেকে জীবনটা একটু ভালো করে কাটানোর চেষ্টা হিসেবে ফেসবুকে অন্যদের লেখা পড়া, নিজের জন্য কিছু লিখে পোস্ট করা, টিভি দেখার সময় আবার একবার সেই পরিচিত নাম্বারে চোখ বুলিয়ে নেওয়া, এসবের মাঝে একধরণের হালকা পেইন ফিল করা, সবাইকে অসহ্য মনে করা, এরপর রাত এবং বাধ ভাঙ্গা চোখের পানি আর শব্দ না হওয়া সুতীব্র চিৎকার; এসবের নামই হচ্ছে একাকীত্ব ! খুব বাজে একটা শব্দ…

একটা একাকীত্ব থাকে, যেখানে নিজেকে অসহায় এবং একদম অবাঞ্ছিত মনে হয়। মনে হয় কেউ এসে জড়িয়ে ধরে রাখবে না, কেউ মাথায় হাত দিয়ে বলবে না সব ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক একদম ঠিক এই সময়টাতেই মনে হয়, যদি হাতের কাছে ১০০ কোটি টাকা থাকত এবং একজন মানুষকে কিনে আনা যেত, তাহলে সেটাই করতাম। সে এসে শুধু আমার পাশে বসে থাকবে, তার কাঁধে মাথা রেখে আমি একটু কাঁদতে পারবো ! জ্বর হলে বিছানায় শুয়ে থাকার সময়টাতেও হয়ত আমরা এমন কোনো আপনজন খুঁজে বেড়াই, কথা বলার জন্য, অথবা মাথায় পানি দিয়ে দেয়ার জন্য। সেখানেও একটা একাকীত্ব থাকে, কেউ থাকে না।

দামী পোশাক পরে রেস্টুরেন্টে ডজনখানেক বন্ধুর মধ্যে হাসিমুখে ছবি তোলা মানুষও অনেক একা। স্যুপের বাটিতে চামচ নাড়তে গিয়ে মনে পড়া কোনো স্মৃতি যখন বুকের ভিতর খামচে ধরে, তখন আমি একা। নিয়ন আলোর রাস্তায় একা রিকশায়, বাসায় ফেরার পথেও আমি একা। কি অসহায় আমি, কি নিষঙ্গ আমি ! আর আমার পাশে বসে থাকা মানুষটা? খুব জানতে ইচ্ছা করে, সে কি করছে? আমি জানি যে, কোথায় কি করছে। ছবিগুলো ল্যাপটপের যে ফোল্ডারে রাখা তা সবার আড়ালে করে আজও আমাকে দেখতে হয়। অপরাধীদের মত তার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। কেনো? ভুল কি? কোথায় ভুল? কিভাবে ভুল? সবাই ভুল করলে কি শাস্তি পায়? আমি কি পাচ্ছি? শুধুই তো একা থেকে আরো একা হয়ে যাচ্ছি।

ফেসবুকের সকল ঝকঝকে ছবির মধ্যে বার বার একটা প্রোফাইলের ছবি কেনো আমাকে এত আলোড়িত করে। কেনো বারবার নিজের এই অসহায় অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য সেই মানুষটার একটু ’হ্যালো’ শব্দটা শুনতে ইচ্ছে করে? কেনো মনে হয় এই জীবনে তাকে না পেলে সবকিছু শূন্য হয়ে যাবে? বার বার কেনো একই ছবি দেখতে ভালো লাগে? একটা ভুল থেকে কেনো এতগুলো মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়? কেনো সবার মধ্যেও একা একা হয়ে থাকতে হয়? কেনো কেনো সেই একই মানুষের হাসির শব্দ কানে আসে? ভোরের আলো ফিকে হয়ে আসে আবার মনে হয় আমার এই বুঝি সকালের খুদে বার্তা এসে যাবে আমার মোবাইলে।

নাহ, আসে নাহ। এখন আর আমাকে তার প্রয়োজন মনে হয় না। এখন আর আমার গলার স্বর শুনে কারো ঘুমাতে ইচ্ছে করে না। এখন আর আমার এলোচুলে রিকশায় কারো ঘুরতে ইচ্ছে করে না। এখন কেউ অনেক অংক কষে হিসাব করে দেখেছে, আমি সেই মানুষ না যার সাথে সে থাকতে পারবে। কিন্তু এই আমাকেই তার খুব দরকার ছিলো। আমাকেই তার খুব দরকার ছিলো বন্ধুদের সামনে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে থাকার জন্য। আমাকেই তার খুব বেশি দরকার ছিলো বদ্ধ ঘরে উত্তপ্ত বিছানার উষ্ণ আলিঙ্গনের জন্য। তখন অংক ছিলো অনেক সরল। আর এখন অংক হয়েছে বীজগণিতের মত, যার শুরুতেই জটিলতা। হিসাব আর মিলে না। জ্যামিতির রেখার মত আনুভূমিক ভালবাসা !

এসব চিন্তা করতে গিয়ে আমার জীবনের একটা হিসাব কষে নিলাম। এই যে নীল দুনিয়া ফেসবুকে কতশত মানুষ আমাকে চিনে, প্রতিদিন কত কমেন্ট, কত লাইকের বন্যা, তারই সাথে কত অপমান, সব কিছুর ভীড়ে ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিন হাসি মুখে বেঁচে থাকার নাম করে দিয়েছে মানুষ ’জীবন’। আর হ্যাঁ, এই জীবন আমি যাপন করছি সেখানে, যেখানে রয়েছে শত অপমান আর বিশ্বাসঘাতক প্রেমিকের তাচ্ছিল্য ভরা হাসি। সঙ্গী করে নিতে হছে সাইবার বুলিং। এসব থেকে কি পেয়েছি আমি? আমি বিলীন এক অস্তিত্বহীন একাকীত্বের মাঝে বসবাস করেই যাচ্ছি। আজকে সব কিছু শেষ করে দিলে কেমন হবে? কেমন হবে যদি আজ গলায় ফাঁস নেই? কেউ কি কাঁদবে? হয়ত কাঁদবে ! আসলে তার কান্নার অনুভূতি জানার চেয়ে আমার তাকে শাস্তি দিতে হবে, এটাই জরুরী। আর এই শাস্তি আমি তাকে দিবো আমার মৃত্যু দিয়ে ! আমি মরে যাবো, হুম, আজকেই আমি মরে যাবো। আমার মৃত্যুর খবর সে জানবে, তার অনেক হাসি পাবে আবার রঙ্গিন দুনিয়ায় ছবি তুলে বেড়াবে, আবার নতুন করে প্রেমিকা খুঁজে নিবে নীল রঙের ফেসবুক পৃথিবীতে ! আরেকজন সেলিব্রেটি হয়ে যাবে।

কিন্তু আমাকে?

আমাকে মনে রাখতেই হবে, বেঁচে থেকে যে সময়টুকু সে আমাকে দেয় নাই, মৃত্যুর পর আমাকে সে সেই সময়টুকু দিবে। আমাকে আর একা করে কোথাও যাবে না সে, আমি যেতে দিবো না। আমি তাকে আমার মৃত্যু দিয়ে ঘিরে রেখে যাবো। থেকে যাবে‍া অনুভূতিহীন কপোট্রনিক হয়ে !

“ভালো থাকো সুমাইয়া সুলতানা আদিবা, একজন হারিয়ে যাওয়া বন্ধু”

Leave a Reply