অক্টোপাস এবং স্কুইড

অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে বহুল আলোচিত দুটি প্রাণী হচ্ছে অক্টোপাস এবং স্কুইড । সামুদ্রিক এই দুটো প্রাণী সম্পর্কে ছারপোকা ম্যাগাজিনের আজকের এই পোস্ট। পড়ে জেনে নিন কেনো এরা এত আলোচিত…

অক্টোপাস এবং স্কুইড

অক্টোপাস এবং স্কুইড (Octopus and Squid) সমুদ্রের দুটি অমেরুদণ্ডী প্রাণী। লম্বা শুঁড়, ছোট দেহ, ক্ষীপ্র গতি, শিকার ও আত্মরক্ষার বিভিন্ন কৌশলের জন্য এই প্রাণী দুটো আলোচিত। এরা ক্ষণিকের মধ্যেই দেহের রঙ পরিবর্তন করতে পারে। এ ছাড়া বিজ্ঞানীরা এদের বুদ্ধির পরিচয় ও পেয়েছেন। প্রায় সব সমুদ্রেই এদের দেখা মেলে।

অক্টোপাসের শরীর

অক্টোপাস শব্দটি গ্রিক শব্দ Oktapous থেকে, যার অর্থ আটটি পা। অক্টোপাসের আটটি করে পা অথবা বাহু আছে। প্রতিটি বাহুতে পেয়ালাকৃতির চোষক থাকে। এর হৃৎপিণ্ড তিনটি। দুটি হৃৎপিণ্ড মস্তিষ্কে রক্ত চালনা করে, অপরটি দেহের বাকি অংশে রক্ত চালনার কাজ করে। লাল রক্তকণিকার বদলে এর রক্তে হিমোসায়ানিন থাকে। ফলে অক্টোপাসের রক্তের রঙ হয় নীল।

অক্টোপাস

সমুদ্রের নিচে পাথরের আড়ালে থাকে অক্টোপাস

এদের চোখ দুটি। প্রখর দৃষ্টিশক্তি থাকার কারণে গভীর পানিতে অক্টোপাস স্বচ্ছন্দ্যে চলাফেরা ও শিকার করতে পারে। এর স্পর্শ ইন্দ্রিয়টি খুব সক্রিয়। তবে অক্টোপাসের শ্রবণশক্তি খুবই সীমিত।

সাধারণত উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকার অক্টোপাস ছোট এবং মেরু এলাকার অক্টোপাস বড় হয়ে থাকে। সবচেয়ে বড় অক্টোপাস দেখা যায় প্রশান্ত মহাসাগরে। এরা ২৩ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। এদের ওজন ২০০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।

অক্টোপাসের জীবন

অক্টোপাস মূলত নিশাচর প্রাণী। এরা সমুদ্রের নিচের দিকে বাস করে। সমুদ্রের নিচের বিভিন্ন গুহা বা পাহাড়ের খাঁজ হলো অক্টোপাসের প্রধান বাসস্থান। শিকারের সন্ধান পেলে এরা গুহা থেকে বের হয় এবং শিকারকে কাবু করে তাকে গুহায় নিয়ে এসে খায়। কাঁকড়া ও বিভিন্ন মাছ এদের প্রধান খাবার। খাবার শিকার করার জন্য অক্টোপাস লালা বা স্যালাইভা ব্যবহার করে। এই লালা মানুষের জন্যও ক্ষতিকর।

পরিণত বয়সের স্ত্রী অক্টোপাস পাথরের ফাটলে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে সেগুলো তীরে চলে আসে এবং জলজ উদ্ভিদের সাহায্যে ভেসে থাকে। এক মাস পর তারা আবার সাগরের নিচে চলে যায়।

অক্টোপাসের বড় প্রজাতিগুলো বেশি দিন বেঁচে থাকে। ছোট অক্টোপাসগুলো এক বছরও বাঁচে না। তবে বড় অক্টোপাস পাঁচ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।

স্কুইডের দশ বাহু

অক্টোপাসের মতো স্কুইডেরও শুঁড় বা বাহু আছে, তবে আটটি নয়-দশটি। শুঁড়ের সংখ্যা দিয়েই স্কুইডকে অক্টোপাস থেকে সহজে পৃথক করা যায়। বিগ ফিন স্কুইডের সব শুঁড় বা বাহু সমান লম্বা। বাকি সব স্কুইডের দুটি শুঁড় বাকীগুলোর চাইতে বড়।

স্কুইডের শরীর

অধিকাংশ স্কুইড দেড় ফুটের মত লম্বা হয়। তবে বিশাল স্কুইড ৪০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এটিই সবচেয়ে বড় অমেরুদণ্ডী প্রাণী। স্কুইড অক্টোপাস থেকে ভারী হয়। স্কুইডের চোখ প্রাণীজগতের মধ্যে সবচেয়ে বড়। এ কারণে বিভিন্ন রূপকথায় বিশাল স্কুইডকে ভয় ও বিপদের লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরা পানিতে খুব দ্রুত চলাফেরা করতে পারে। এমনকি ছোট ছোট লাফও দিতে পারে। স্কুইডের দেহ ক্রোমাটোফোর নামক কোষ দিয়ে গঠিত। এর সাহায্যে পরিবেশ অনুযায়ী স্কুইড তার গায়ের রঙ পরিবর্তন করতে পারে। স্কুইডের দেহ বেশ নরম এবং এতে শক্ত কোনো খোল বা আবরণ থাকে না। অক্টোপাসের মতো এর বাহুতে সারি সারি চোষক থাকে। স্কুইড এই চোষকের সাহায্যে কোনো কিছি আঁকড়ে ধরতে পারে। এ ছাড়া গন্ধ নেওয়া এবং অনুভবের সময় চোষক কাজে লাগে।

স্কুইডের দৃষ্টিশক্তি খুব প্রখর। এদের চোখের লেন্স বেশ শক্ত। মানুষের মতো এর লেন্সের আকার পরিবর্তন হয় না।
বরং ক্যামেরার মতো লেন্স সামনে-পেছনে নিয়ে স্কুইড লক্ষ্যবস্তুর অবস্থান নির্ণয় করে।

স্কুইড

Squid with Ink

আত্মরক্ষা ও বুদ্ধিমত্তা

স্কুইড এবং অক্টোপাসের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা খুব ভালো। এরা চোখের পলকেই রঙ পরিবর্তন করতে পারে, ফলে শিকারি প্রাণীটি তাদের খুঁজে পায় না আবার আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে এরা এক ধরনের কালি ছুড়ে দেয়, যা শিকারি প্রাণীকে উল্টো সমস্যায় ফেলে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অক্টোপাস আটটি শুঁড়ের যে কোনোটি ফেলে পালিয়ে যায়। পরে সেখানে নতুন শুঁড় জন্ম নেয়।

বড় মস্তিষ্কই স্কুইড ও অক্টোপাসকে অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান করে তুলেছে। এরা মাছ এবং সরীসৃপদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। প্রতিটি অক্টোপাসই নিজে নিজে শেখে। কারণ, এরা বাবা-মার কাছ থেকে বংশগতভাবে তেমন কোন বুদ্ধিমত্তা লাভ করে না। পরিক্ষায় দেখা গেছে, এরা বিভিন্ন আকার-আকৃতির মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারে। এ ছাড়া বিজ্ঞানীরা অক্টোপাসকে বিভিন্ন হাতিয়ার, যেমন নারকেলের খোল ব্যবহার করতে দেখেছেন।

যেভাবে চলে অক্টোপাস এবং স্কুইড

অক্টোপাস ও স্কুইড অনেকটা জেট বিমানের কৌশল কাজে লাগিয়ে চলাচল করে। পেশি ফুলিয়ে এরা প্রথমে অনেক পানি ভেতরে নেয়। তারপর পেশি দ্রুত সংকোচন করে সব পানি পেছন দিক দিয়ে ছেড়ে দেয় এবং সামনে এগিয়ে যায়। যত বেশি পানি ছাড়া হয়, বেগও তত বেশি হয়।

উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের তিন হাজার ফুট নিচেও স্কুইড বাস করে। সেখানকার স্কুইডদের ফটোফর নামের একটি তন্ত্র থাকে। এর মাধ্যমে তৈরি আলোর সাহায্যে স্কুইড চলাফেরা করে।

অক্টোপাস এবং স্কুইড সম্পর্কিত মজার তথ্য

আক্রমণের শিকার হলে অক্টোপাস এবং স্কুইড যে কালি ছুড়ে দেয়, তার মূল উপাদান হলো মেলানিন। এই মেলানিন মানুষের চুল এবং শরীরের রঙের প্রধান রাসায়নিক উপাদান।

অক্টোপাস অমেরুদণ্ডী প্রাণী। দেহের ভেতরে বা বাইরে কঙ্কাল জাতীয় কোন শক্ত গঠন নেই। পুরো শরীরটি শুধু মাংসপেশি দিয়ে গঠিত। এ কারণে অক্টোপাস তার শরীরকে ইচ্ছামত সংকুচিত বা প্রসারিত করতে পারে।

সবচেয়ে সাহসী স্কুইড হলো হামবোল্ড স্কুইড। এরা আকারে বেশ বড় এবং ক্ষিপ্র। এরা হাঙরকেও আক্রমণ করে। গায়ের রঙ লাল হওয়ায় উপকূলীয় স্থানীয়রা একে “লাল শয়তান” বলে।

বিজ্ঞানীদের ধারনা, আগে স্কুইড অগভীর পানিতে বাস করত। তারা ছিলো মন্থর গতির। ধীরে ধীরে তারা গভীর পানিতে বাস করার উপযোগী হয়।

খাবারের তালিকায় বুদ্ধিমান প্রাণী

চীন, জাপান, ভারত, দক্ষিন কোরিয়া, ইতালি, পর্তুগাল, তুরস্ক ইত্যাদি দেশে অক্টোপাস এবং স্কুইড খুব জনপ্রিয় খাবার। জিংক, ম্যাঙ্গানিজ এবং প্রচুর ভিটামিন থাকায় এটি স্বাস্থ্যকরও বটে ! বর্তমানে বাংলাদেশেও অক্টোপাস বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। দিল্লি দরবার, কাবানা, ক্রিস্টাল প্যালেস সহ আরো কয়েকটি রেস্টুরেন্টে অক্টোপাস ও স্কুইডের নানান রকমের রেসিপি পাওয়া যায়। তবে এগুলোর বেশিরভাগই সামুদ্রিক নয়, নিজস্ব খামারে চাষকৃত !

Leave a Reply