স্বাধীন বাংলার ৪র্থ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন একজন স্বঘোষিত রাজাকার !

একজন আত্মস্বীকৃত রাজাকার ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী ! শুনতে কেমন লাগে কথাটা? খারাপ লাগলেও এটাই সত্য। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয়‍া একজন রাজনীতিবিদ শাহ আজিজুর রহমান, যাকে কিনা স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান বানিয়ে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ! শাহ আজিজুর রহমান শুধু মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষেই ছিলেন না, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধেও শক্ত অবস্থান ছিলো তার…

ভাষাভিত্তিক আন্দোলনকে তিলে তিলে দেশভিত্তিক আন্দোলনে রূপ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটা ঠিকই খেয়াল করেছিলো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিরা। তাই বিভিন্ন সময় তারা একুশের চেতনাকে কৌশলে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিলো। বাংলা ভাষাকে “বাংলাদেশি ভাষা” নামকরণ করতে চাওয়াটা তারই একট‍া অংশ।

১৯৭৯ সালে সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ বলে অভিহিত করে বাংলা ভাষার নতুন নামকরণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। অথচ বাংলাদেশের মূল ভীতটাই দাঁড়িয়ে আছে বাংলা ভাষার উপরে !

রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তাঁর সাথে পরামর্শ ছাড়াই কি শাহ আজিজুর রহমান সংসদের মত জায়গায় দাঁড়িয়ে এত বড় কথাটি বলে ফেলেছিলেন? এই প্রশ্ন আজও অনেকের মনে ভেসে বেড়ায়…

অনেকেই হয়ত জানেন না, সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমান বেশকিছু স্পর্শকাতর শব্দের পরিবর্তন করে নতুন শব্দের প্রবর্তন করেন। তিনি ‘বাংলাদেশ বেতার’ শব্দের পরিবর্তন করে চালু করেন ‘রেডিও বাংলাদেশ’, ‘চালনা বন্দর’ পরিবর্তন করে ‘পোর্ট অব চালনা’,’জয় বাংলা’ স্লোগানের পরিবর্তে চালু করে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ‍এবং ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ এর পরিবর্তে চালু করেন ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’। বাংলা ভাষার অভিধান থেকে তিনি ‘নিমন্ত্রণ’ শব্দটি প্রায় উঠিয়ে দিয়েছিলেন। এর প্রতিবাদ করেছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মালেক উকিল। এজন্য তার মত একজন শ্রদ্ধেয় জননেতাকে জিয়াউর রহমানের অনুসারী ও সমর্থক দলের লোকজনেরা ‘ভগবান দাশ’ বলে বিদ্র‍ুপ করেছিলেন। যা ছিলো অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ব্যাপার…

১৯৭৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখ, ভাষা আন্দোলন দিবসের এই মহান দিনে সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজ ইংরেজিতে ভাষণ দিয়ে ভাষা শহীদদের অপমান করেছিলেন। একমাত্র ড. মযহারুল ইসলাম এই জঘন্য ধৃষ্টতার বিরোধিতা করেছিলেন। আর কোনো পণ্ডিতও সেদিন টু শব্দ করেননি।

Sheikh Mujibur Rehman in Lahore

Sheikh Mujibur Rehman in Lahore

প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজ‍ুর রহমান যে একজন আত্মস্বীকৃত রাজাকার এবং তিনি রাজাকারদের সমর্থনে ছিলেন, এই সত্যটাকে মিথ্যা বানাতে তখন তাদের অনুসারীরা গুজব রটান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে নাকি শাহ আজিজ পাকিস্তান গেছেন। এটি একটি মিথ্যা তথ্য। সত্যটা তুলে ধরছি –

২০০৭ সালের ১৪ই জুলাই, ডঃ কাজী গোলাম নবী তার ফ্লিকার একাউন্টে উপরের ওই ছবিটি আপলোড করেন, যার ক্যাপশন ছিলো, “Sheikh Mujibur Rehman in Lahore : Bangladesh was recognized by Pakistan during this Summit. A year later Mujib was shot dead by his own army officers.”

২০১২ সালের অক্টোবর মাসে, ওই ছবিতে মন্তব্যকারী এক ব্যক্তির প্রশ্নে জবাবে বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকা লোকটি সম্পর্কে কাজী গোলাম নবী বলেন –

“Thanks – he appears to be the protocol person assigned for Sheikh Mujibur Rehman.”

শাহ আজিজুর রহমানের জন্ম হয়েছিলো ১৯২৫ সালে। এই ছবিতে আপনারা বঙ্গবন্ধুর পিছনেই তোফায়েল আহমেদকে দেখতে পাবেন। তোফায়েল আহমেদের জন্ম হয়েছিলো ১৯৪৩ সালে। ছবিটি ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে তোলা। যখন তোফায়েল আহমেদের বয়স ৩১। শাহ আজিজের বয়স তখন ৪৯। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স ছিলো ৫৪। ছবিতে বঙ্গবন্ধুর পাশের লোকটিকে মোটেই ৪৯ বছর বয়সী লাগছে না। তখন টিভি, পত্রিকা সহজলভ্য ছিলো না। দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেশিরভাগ মানুষ শুধু উপরশ্রেণীর লোকদের নামই শুনে এসেছেন। চেহারা দেখে চেনার খুব একটা অবকাশ ছিলো না। তবে ওই সময়টাতে যারা শাহ আজিজুর রহমানকে দেখেছেন, তারা ঠিকই একবাক্যে বলে দিতে পারেন, ছবির এই লোকটি শাহ আজিজ নয় ! শাহ আজিজ ভারী চশমা পড়তেন। ছবিতে বঙ্গবন্ধুর পাশের যে লোকটিকে শাহ আজিজ বলা হচ্ছে, তার চোখে চশমা নেই।

শাহ আজিজের মুক্তি

দৈনিক বাংলা পত্রিকায় শাহ আজিজের মুক্তির খবর

এত যুক্তি দেখানোর আসলে কিছুই নেই। যুক্তিগুলো খুটিয়ে নাটিয়ে দেখানো হচ্ছে, যাতে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির অনুসারীদের রটিত মিথ্যাচারে বিভ্রান্ত হয়ে তরুণ প্রজন্ম ভুল ইতিহাসকে গ্রহণ না করে। এটাই সত্য যে, স্বাধীন বাংলাদেশের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ছিলেন একজন আত্মস্বীকৃত রাজাকার !

একনজরে প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান

  • প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ১৯২৫ সালের ২৩ নভেম্বর কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
  • তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (সম্মান) ডিগ্রি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএল ডিগ্রি লাভ করেন।
  • ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতিতে অংশ নেয়া এই ব্যক্তি ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৭ সালে অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং একইসাথে তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
  • ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। এসময় তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।
  • শাহ আজিজুর রহমান ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক থেকে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল থাকেন
  • ১৯৬২ সালে মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থায় কুষ্টিয়া থেকে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন।
  • ১৯৬২ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টে যোগ দেন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
  • ১৯৬৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং অল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হন।
  • ১৯৬৫ সালে মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার নির্বাচনে কুষ্টিয়া এনই-৩৩ নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
  • ১৯৬৫ সালের জুন মাসে তিনি জাতীয় পরিষদে সম্মিলিত বিরোধী দলের (কপ) উপনেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
  • আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বিবাদী পক্ষের অন্যতম আইনজীবী ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান। অবশ্য ১৯৭০ সালে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কার্যক্রমের জন্য তাকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
  • শাহ আজিজ ১৯৭০ সালে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় লীগে যোগ দেন এবং দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে কুষ্টিয়া-৩ নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন।
  • ১৯৭১ সালে শাহ আজিজুর রহমান বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেন। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক জাতিসংঘে প্রেরিত প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য ছিলেন শাহ আজিজ। তিনি জাতিসংঘে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করলেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে !
  • স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধীতা করার দায়ে ১৯৭১ সালের পর ‘পাকিস্তানের সহযোগী’ হিসেবে শাহ আজিজকে গ্রেপ্তার করা হয়। দালাল আইনে তার বিচার হয়।
  • ১ ডিসেম্বর ১৯৭৩ তারিখ দৈনিক বাংলা পত্রিকার সূত্রে জানা যায়, “স্বাধীনতা বিরোধী শাহ আজিজুর রহমান ও শর্ষিণার পীর সাহেব সাধারণ ক্ষমার আওতায় মুক্তি লাভ করেছেন”। অভিয‍ুক্তদের মধ্যে যারা গণহত্যা ও ধর্ষণের মত ভয়ংকর কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না, সেই ধারার আওতায় প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের সাধারণ ক্ষমার অধীনে শাহ আজিজুর রহমান মুক্তি পান।
  • ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত জিয়া কর্তৃক আনব্যানকৃত বাংলাদেশ মুসলিম লীগের মাধ্যমে রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
  • ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে শাহ আজিজুর রহমানকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। শাহ আজিজুর রহমান ছিলেন বিএনপি সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী।
  • ১৯৮২ সালে হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করে শাহ আজিজুর রহমানকে পদচ্যূত করেন।
  • ১৯৮৮ সালে শাহ আজিজুর রহমান মৃত্যুবরণ করেন।