হুমায়ূন আহমেদের হিমু চরিত্রটি আসল না নকল ?

হুমায়ূন আহমেদ রচিত সাহিত্যগুলোর মধ্যে যে কয়টি চরিত্র সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তার মধ্যে হিমু অন্যতম। অনেকের মতে, হিমুর জনপ্রিয়তাই সবচেয়ে বেশি। হিমু এমন একটি চরিত্র, যাকে কোনো অনুশাসনের মধ্যে বেঁধে রাখা যায় না। এই হিমু হচ্ছে হলুদ পাঞ্জাবী পরে খালি পায়ে হেঁটে চলা এক ভবঘুরে যুবক, যে কিনা দিন-রাত অবিরাম হেঁটে চলে শহরের পথেঘা‍ঁটে, অলিতে গলিতে। উপকার করে বেড়ায় বিপদে পড়া মানুষদের…

‘হিমু’ নামে এই চরিত্রটির ভাবনা হুমায়ূন আহমেদ স্যারের মাথায় কিভাবে আসলো, তা আমার জানা নেই। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে হাজারো সমালোচকদের এটাও বলতে শুনেছি, হিমু চরিত্রটি নাকি হুমায়ূন আহমেদের মস্তিস্কপ্রসূত নয়। তিনি নাকি এই চরিত্রটি নকল করেছেন !

হিমু চরিত্রটি আসল না নকল, সেই সিদ্ধান্তে আসতে না পারলেও, হিমুর সাথে মিল পাওয়া যায় এমন দুটি চরিত্রের কথা আজ আমরা বলবো। পড়ে ফেলুন…

জোনাথন স্মিথ (Highway to Heaven)

হিমুর প্রায় সবগুলো গুণই খুঁজে পাওয়া যায় ‘জোনাথন স্মিথ’ এর ম‍াঝে, যে কিনা জিন্স প্যান্ট আর জ্যাকেট পরে ভবঘুরের মত রাস্তায় ঘোরাঘুরি করত এবং সেইসাথে মানুষের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে বেড়াত !

জোনাথন স্মিথ হচ্ছে আমেরিকার বিখ্যাত টিভি সিরিজ ‘হাইওয়ে টু হেভেন’ এর একটি চরিত্র। হিমুর আমেরিকান সংস্করণ বলা চলে তাকে। ১১১ পর্বের জনপ্রিয় এই টিভি সিরিজটি প্রচারিত হয়েছিলো ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত। ঠিক তার পরের বছরেই ১৯৯০ সালে ‘হিমু’ চরিত্রটি নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘ময়ূরাক্ষী’ প্রকাশিত হয়।

হিমুর সাথে মিলে যাওয়া আরেকটা চরিত্রও রয়েছে…

হিমাদ্রি হিমু (শুন বরনারী)

১৯৬০ সালের দিকে ‘শুন বরনারী’ নামে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিলো। এই সিনেমার মূল চরিত্র ছিলো হিমাদ্রি (ডাকনাম হিমু) নামের ভ্যাগাবন্ড এক যুবক, যার কাজ ছিলো কখনো হোমিওপ্যাথির ওষুধ বিক্রি করা, কখনো অভিভাবকদের অনুরোধে তাদের মেয়েকে ট্রেনে করে বাড়িতে পৌঁছে দেয়া, সমাজের যেকোনো স্তরের মানুষদের সাথে সহজে মিশে যেতে পার‍া ইত্যাদি। দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের কাছে এই ভ্যাগাবন্ড তরুণটি ছিলো পরম নির্ভরতার জায়গা ! মেয়েরা তার অজান্তেই তার প্রতি দুর্বল হয়ে পরে, শুরু হয় জটিলতা। এমনটাই ছিলো ‘শুন বরনারী’ সিনেমার গল্প…

পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত লেখক সুবোধ ঘোষের লেখা “শুন বরনারী” উপন্যাস অবলম্বনে একই নামে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন পরিচালক অজয় কর। Suno Baranari (১৯৬০) সিনেমার হিমু ছিলো হুমায়ূন আহমেদের হিমুর মতই এক অদ্ভুত যুবক, যার জীবনের কোনো লক্ষ্য নেই। যার কাজ শুধুই মানুষের উপকার করে বেড়ানো। এমন অভিনব চরিত্র বাংলা সিনেমায় আগে কখনো দেখা যায়নি। তাই সেসময় এই চরিত্রটি পশ্চিমবঙ্গে বেশ জনপ্রিয়তা পায় !

হুমায়ূন আহমেদের হিমু চরিত্রটি আসল নাকি নকল ?

ইদানিং অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, “হিমু চরিত্রটি হুমায়ূন আহমেদের নিজের সৃষ্ট নয়। তিনি চরিত্রটি কপি করেছেন”। এই অভিযোগের বিপরীতেই আজকের এই পোস্টটি লিখতে হচ্ছে।

এটাকে আসলে কোনোভ‍াবেই কপি বা নকল বলা যায় না। হতে পারে, এই দুটো চরিত্রের মধ্যে কোনো একটা থেকে হুমায়ূন আহমেদ শুধুমাত্র ‍আইডিয়া নিয়েছিলেন এবং সেটাকে নিজের মত করে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু ব্যাপারটা এমন না যে তিনি পুরো চরিত্রটাই কপি করেছেন। আমরা আমাদের যে হিমুকে চিনি, সেই হিমু শুধ‍ুই আমাদের হলুদ হিমু…

জিন্স টিশার্ট পরে আমরাও তো কতসময় হিমুর মত উদ্দেশ্যহীন ভাবে রাস্তায় হেঁটে বেড়াই। তারমানে তো এই নয় যে আমরা হিমুকে নকল করছি। তাই না? বলা যেতে পারে, আমরা হিমুকে অনুসরণ করছি। হলুদ পাঞ্জাবী পরে নকল হিমু সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছি না…

একমাত্র হুমায়ূন আহমেদই ‘হিমু’ চরিত্র‍টিকে প্রাণ দিতে পেরেছিলেন। যা আর অন্য কোনো চরিত্রের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায়নি !

Leave a Reply