দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী এক পিয়ানোবাদকের গল্প

মানব সভ্যতার সবচাইতে নৃশংসতম হত্যাজজ্ঞটি হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। নাৎসী বাহিনী কর্তৃক পোল্যান্ড আক্রমণের মাধ্যমেই সেই যুদ্ধের সূচনা হয়। মানবতার যে তখন কত অধপতন হয়েছিল তা নিজ চোখে যারা দেখেছিলেন তারাই সেটা বলে গিয়েছেন। এসব হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলার কাহিনী অনেকেই হয়ত জানেনা। তা নিয়েই ছারপোকা ম্যাগাজিনের আজকের এই পোস্ট। লিখেছেন আশিকুল ইসলাম। লেখককে ফেসবুকে ফলো করুন‍ঃ  Ashikul Islam

পোল্যান্ডের এক পিয়ানোবাদক ছিল। যার নাম হচ্ছে ওয়াল্ডিশ্লো স্পিলমান (Wladyslaw Szpilman)। তিনি তখনকার সময়ে পোল্যান্ডের একটি রেডিও স্টেশনে পিয়ানো বাজাতেন। পোল্যান্ডের ওয়ারশো অঞ্চল তখন নাৎসী বাহীনির দখলে। একদিকে চলছে প্রাণ নাশের আয়োজন, বোমা-গোলাবারুদের বিকট শব্দ আর অন্যদিকে চলছিল পিয়ানোর সুর। কোনকিছুই তাকে পিয়ানো বাজানো থেকে পিছু হটাতে পারেনি। সে নিজের মতো পিয়ানোতে সুরের ঝংকার তুলে গিয়েছে। কিন্তু একসময় যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সেটাও তাকে ছেড়ে দিতে হয়। এমনকি সেই রেডিও স্টেশনটিও নাৎসী বাহিনী গুড়িয়ে দেয়।

সেই পিয়ানোবাদক দেখে বলে গিয়েছেন মানবতার সেই নিদারুণ গল্পগুলো। নাৎসী বাহীনির ভয়ে এক দম্পতি তাদের কোলের দুধের শিশুকে নিয়ে ঘরে আত্মগোপন করেছিল। কিন্তু বাচ্চার কান্নার শব্দে সেটা সম্ভব হয়ে উঠছিল না। তাই প্রাণ রক্ষা করতে গিয়ে মা তার দুধের শিশুর মুখে হাত চেপে ধরে রেখেছিল। নাৎসী বাহীনি চলে যাওয়ার পর টের পেল যে তাদের সন্তানটি দম বন্ধ হয়ে মারা গিয়েছে। মা তার সন্তানকে নিজ হাতে নিজের অজান্তেই হত্যা করেছে। এদিকে আরেক মা এক ফোঁটা পানির জন্য হাহাকার করছিল তার তৃষার্ত সন্তানকে বাঁচাতে।

যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ওয়াল্ডিশ্লো স্পিলমান ও তার পরিবার শহর ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে তার আর যাওয়া হয়নি। তার নিজের বেঁচে থাকাটা প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। ঘটনাক্রমে তার স্থান হয় নাৎসী বাহিনীর ক্যাম্পে। সেখানে তিনি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন আর দিনের দিনের পর দিন এবং নির্যাতিত হন। কোন কোন সময় নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকেও বেঁচে গিয়েছিলেন। চোখের সামনে থেকে শত শত মানুষের মৃত্যু দেখেছেন। নিজেও হয়তো সেভাবে একসময় মারা পড়বেন ঠিক এমনটাই ভেবে রেখেছিলেন। কিন্তু সেটার মুখোমুখি তিনি হতে চাননি। তাই সে একাই ক্যাম্প থেকে পালাতে সমর্থ হয়েছিলেন।

ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন তার ভক্তের কাছে। তাকে একাই একটি বাড়িতে গোপন রাখা হয়েছিল। যার আশে পাশে ছিল সব খ্রিষ্টানদের বসবাস। যেখানে কিনা তার প্রাণ নাশের ভয় ছিল আরও বেশি। যদি কেউ টের পায় তাহলে তাকে সেখানেই মেরে ফেলা হবে। সেই বাড়িটিতেও একটা পিয়ানো ছিল। কিন্তু সেখানে সেটা বাজাতে পারেনি প্রাণ হারাবার ভয়ে। একা একা থাকতো বাড়িটির ভিতর। আর তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা সেখানে তার খাবার সরবারহ করে যেত। হাতের ঘড়িটা পর্যন্ত বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিল খাবারের জন্যে।

Wladyslaw Szpilman

The famous photo of Wladyslaw Szpilman

১৯৪৫ সালে যদ্ধ চলাকালীন সময়ে সে সেখানে অনেকদিন অবস্থান করেছিল। তখন ছিল শীতকাল। এদিকে খাবারের সরবারহও নেই। এক ফোঁটা পানিও সে খেতে পারছিল না। এমনকি মাস দেড়েক সে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারেনি কোন মানুষের সাথে। শেষে খাবারের অভাবে আক্রান্ত হলেন নানা প্রকার রোগে। মৃত্য ছিল তখন তার নাকের ডগায়। বিছানায় অবচেতন হয়ে পড়েছিলেন দিনের পর দিন। সে যাত্রায়ও তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। তার আশ্রয়দাতা মাসখানেক পর এসে দেখতে পেল স্পিলমান প্রায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। সামান্য চিকিৎসা আর আহারের পর সে আবার কিছুটা সুস্থ্য হয়ে উঠেছিল। এক পর্যায়ে তার সেই আশ্র‍য়স্থলটিও ত্যাগ করতে হয়।

থাকার মত কোনও জায়গা ছিল। এদিকে ইহুদীদের যেখানেই পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই হত্যা করা হচ্ছে। পেটে পাহাড় সমান ক্ষুধা নিয়ে আত্মগোপন করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সেই পিয়ানোবাদক। একটু খাবারের আশায় শহরের ধ্বংসস্তূপকে কুকুরের মত তালাশ করে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু কোথাও কোন খাবার পায়নি।

যুদ্ধবিদ্ধস্ত এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন। সেখানে তাকে ধরে ফেলে এক জার্মানী অফিসার। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে পাগল। কিন্তু পরবর্তীতে সেই অফিসার স্পিলমানের কথা বার্তায় বুঝতে পারল যে সে পাগল না। যুদ্ধ আর আর ক্ষুধা তাকে পাগল বানিয়েছে। অফিসার তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, সে কি করে? বেঁচে থাকার কারণ কি?

উত্তরে স্পিলমান বলেছিল সে একজন পিয়ানোবাদক। সে আগের মতো করে আবারো পিয়ানো বাজাতে চায়, বেঁচে থাকতে চায়। পিয়ানিস্ট শুনে শত্রু অফিসার তাকে পরিত্যক্ত পিয়ানোটার কাছে নিয়ে যান এবং তাকে কিছু একটা বাজাতে বলেন। তারপর স্পিলমান আগের মত করে সেই পিয়ানোতে সুরের ঝংকার তুলে। যা শুনে সেই অফিসার ওয়াল্ম হোসেনফিল্ড বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। স্পিলমানের পিয়ানোর সুর তাকে এতোটাই করে যে অফিসার হোসেনফিল্ড ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে তার জন্য খাবার সরবারহ দিয়ে যায়, হত্যা করেনি। আর বলে যায় তুমি যেখানে লুকিয়ে ছিলে সেখানেই লুকিয়ে থাকো।

তার কিছুদিন পর অফিসার (ওয়াল্ম হোসেনফিল্ড) আবার আসে স্পিলমানের জন্যে খাবার নিয়ে। চলে যাওয়ার সময় তাকে জিজ্ঞেস করে, যুদ্ধ শেষে কি করবে? স্পিলমান বলে, সে আবার সেই পোলিশ রেডিও স্টেশনে পিয়ানো বাজাবে। একথা শুনে হোসেনফিল্ড তার নামটা জেনে যায় এবং বলে যে, সে তার পিয়ানো বাজানো শুনবে রেডিওতে। তখন স্পিলমানও তার কাছে যুদ্ধাবস্থা কি সেটা জানতে চায়! অফিসার তাকে বলে রাশিয়ানরা আসছে পোল্যান্ডে থেকে আমাদের বিতারিত করতে। আমরা চলে যাচ্ছি। এবং একথা বলে অফিসার তার গায়ের অফিসিয়াল কোটটা স্পিলমানকে দিয়ে যায়, যাতে ঠান্ডার মধ্যে তার কোন কষ্ট না হয়।

পরবর্তীতে পোল্যান্ড শত্রুমুক্ত হয়। এবং সেই অফিসার সোভিয়েত সৈন্যদের কাছে আটক হয়। অফিসারের তখন পোলিশ এক মিউজিশিয়ানের সাথে কথা হয়। সে তার প্রাণ বাঁচাতে স্পিলমানের কথা তাকে বলে। সে স্পিলমামকে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করে, খাবার দেয়, সুযোগ পেয়েও হত্যা করেনি তাকে। এদিকে স্পিলমান আবারো রেডিও স্টেশনে পিয়ানোতে সুরের ঝংকার তুলে দেয়া শুরু করে দিয়েছে। সে আগের মত পিয়ানো বাজায় রেডিওতে। কিন্তু সেই অফিসারের খবরটা তার কানে সময়মত পৌঁছায়নি। যখন সে এটা জানতে পেরেছে যে অফিসার সোভিয়েত সৈন্যের কাছে আটক হয়েছে তখন আর সে বেঁচে নেই। ওয়াল্ম হোসেনফিল্ড ১৯৫২ সালে সোভিয়েত যুদ্ধবন্দি কারাগারে নিহত হন।

Leave a Reply