সুইসাইড নয়, সমাপ্তির সূচনায় সাফল্য !

আত্মহত্যা একটি সাধারণ ও ঘৃণ্য সমীকরণ। জীব বিজ্ঞানের ভাষায়, প্রাণ আছে এমন কোনো জৈব পদার্থের জীবনের সমাপ্তিকে মৃত্যু বলে। আর এই মৃত্যু দুই ভাবে সংঘটিত হয়ে থাকে।

  1. প্রাকৃতিক ভাবে (ঐশ্বরিক)
  2. কৃত্রিম ভাবে

কৃত্রিম মৃত্যু বলতে আমরা আত্মহত্যাকে বুঝি। কৃত্রিম বা আত্মহননের মধ্য দিয়ে সোমাটিক মৃত্যুর (সামগ্রিকভাবে মৃত্যু) পূর্বে হননকারীর আরও কয়েকটি পর্যায়ে মৃত্যু ঘটে। প্রথমে বিবেকের, পর্যায়ক্রমে মনুষ্যত্বের, মস্তিকের এবং তার অনাগত ভবিষ্যতের। কারণ হিসেবে প্রেমাবেগ, ব্যর্থতা, ও মানসিক ভারসাম্যহীনতাকে চিহ্নিত করেন অনেকে।

সারাবিশ্বে প্রতি বছর প্রায় দশ লক্ষাধিক মানুষ সুইসাইড করার মত জঘন্য পদ্ধতি ব্যবহার করে। ক্রমান্বয়ে এই সংখ্যা বর্ধিত হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশেও এর নেতিবাচক প্রভাব অতীতকে ছাড়িয়ে গেছে। এই বিষয়টি সর্বাধিক পরিলক্ষিত হয় Teenager থেকে ৩৫ মধ্যবর্তী পুরুষ-মহিলাদের মধ্যে। তন্মধ্যে মহিলার সংখ্যাই বেশি (সূত্র বিভিন্ন গণমাধ্যম)।

বিশেষজ্ঞদের মতে এই বয়সটায় পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের মধ্যে আবেগ, আত্মসম্মানবোধ, দুঃসাহসিক মনোভাব আকৃষ্ট করে। আর কোথাও ক্ষুণ্ণ হলেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। যার সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে এই “আত্মহত্যা” শব্দটা !

এপর্যায়ে আমরা বিখ্যাত কিছু সুইসাইড নোট দেখে আত্মহত্যার কারণগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হবো –

“সবই গেল ভেঙে, হলো সবই সারা,
জলুক তবে আজ এ চিতাটা আমার !
উৎসবও নেই, নিভে গেছে আলো
যা ছিল থামার!” – রবার্ট ই. হোয়ার্ড (ব্যর্থতা)

“আমি স্বয়ং সস্ত্রীক মরদেহের উপর শত্রু পক্ষের বর্বর উল্লাস এড়াতে মৃত্যুকেই বেছে নিলাম।” – এডলফ হিটলার (আত্মসম্মানবোধ)

“এবং অবশেষে আমি এই পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছি, যেখানে কেবল হৃদয় ভাঙে অথবা বদলাতে হয়।” – নিকোলাস সেবাস্টিয়ান (প্রেমাবেগ)

উপরোক্ত সুইসাইড নোটগুলো পর্যালোচনা করলে আমরা বুঝতে পারি আবেগ, আত্মসম্মানবোধ এবং ব্যর্থতার তাড়নায় বিবেক, সেন্স অব হিউমার, ও ভবিষ্যৎ ভাবনা গুলোর মৃত্যু ঘটায়, যা সামগ্রিক মৃত্যুর পূর্ব মৃত্যুর পরিচয় বহন করে।

আত্মহত্যাকে আমরা যদি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করি, তবে এটা পরিষ্কার মৃত্যু পরবর্তী চিরস্থায়ী জীবনে আত্মহননকারীর শান্তির আশা তো নেই বরং শাস্তি সীমাহীন…

ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন – “পৃথিবী হচ্ছে আখিরাতের শস্য ক্ষেত্র।” অর্থাৎ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে একমাত্র স্রষ্টার ইবাদতের জন্য। অথচ আমরা দুনিয়ার নানা রঙে রঙিন হয়ে আমাদের লক্ষ্য ভুলে ক্ষণস্থায়ী জীবনকে প্রাধান্য দিচ্ছি। ফলশ্রুতিতে জীবনের রঙ যখন সাদা কালো হয়ে যায় তখন বেছে নিচ্ছি আত্মহনন এর পথ। কাজের কাজ কিছুই হলোনা।

এসম্পর্কে পবিত্র কোরআন শরীফে সূরা নিসায় বর্ণিত আছে- “আর তোমরা নিজেদের হত্যা করোনা। নিশ্চই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু। এবং যদি কেউ জুলুম করে, অন্যায়ভাবে উহা(আত্মহত্যা) করে আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করবো।(আয়াত-২৯-৩০)।

পবিত্র বাইবেলে বলা হয়েছে – একমাত্র ঈশ্বরই সিদ্ধান্ত নেবেন যে কখন কিভাবে মানুষের মৃত্যু হওয়া উচিত। এবং আত্মহত্যা হলো ঈশ্বরের বিরুদ্ধে ভয়ানক পাপ।

এছাড়াও প্রায় প্রত্যেক ধর্মেই আত্মহত্যা নিষিদ্ধ ও কঠিন শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে।

সাহিত্যিক, বিশ্বকবি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও বেঁচে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন –

“মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর এ ভুবনে
মানবের তরে আমি বাঁচিবারে চাই”

অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্বে এমন কীর্তি স্থাপন করে যাও, যা মৃত্যু পরবর্তী সময়েও তোমাকে মানুষের মাঝে বাঁচিয়ে রাখবে আর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। আর আত্মহত্যা তো জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া ব্যতীত কিছুই নয়, কোন স্বার্থকতাও নেই।

আত্মসম্মানবোধ যদি থেকেই থাকে, তবে বেঁচে থেকে অর্জন করতে হবে। ব্যর্থতাকে যদি গুঁজতে হয়, তবে বেঁচে থেকে সফল হয়ে দেখাতে হবে। জুলুমকারীর পুরষ্কার মৃত্যু দিয়ে নয় বেঁচে থেকে প্রতিবাদ করো। প্রেমাবেগ দিয়ে নয় বিবেক দিয়ে জীবন পরিচালনা করো।

বাংলা অভিধানে যখন আত্মহত্যার মানে খুঁজি তখন আশেপাশের বেশ কিছু শব্দ আমাকে আলোড়িত করে….

  1. আত্মবিশ্বাস
  2. আত্ম প্রত্যয়
  3. আত্ম মূল্যায়ন
  4. আত্মসম্মান
  5. আত্ম অন্বেষণ

আফসোস হয়, আত্মহননকারী যদি একবার এই শব্দগুলোর উপর আস্থা, বিশ্বাস স্থাপন করতে পারত। আহা!, এগুলার মাঝেই তো জীবনের অর্থ, গতিপথ খুঁজে পেতে পারত।

আপনি কেনো করছেন আত্মহত্যা? আঁকড়ে ধরে বাঁচার মত কিছুই নেই? আমাদের চারপাশে প্রকৃতি থেকে শিখুন কিভাবে বাঁচতে হয়। কেননা আল্লাহর সকল সৃষ্টি এই মানুষের জন্যই। সূর্য অস্ত যায়, আর কি উদিত হয় না? পথের শেষ হয়, নতুন পথ কি সৃষ্টি হয় না? অবশ্যই হয়। যেখানে বাংলাদেশের শেষ, সেখানে ভারত শুরু। আবার যেখানে ভারত শেষ, সেখানে চীনের শুরু। অর্থাৎ জীবন যেখানে থেমে যাচ্ছে, সেটাই থেমে যাওয়া নয়। নতুন কিছু সৃষ্টি হওয়ার পূর্বাভাস মাত্র। তার জন্য আপনাকে বেঁচে থেকে অপেক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ সমাপ্তির সূচনায় বিশ্বাস করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

সর্বোপরি বলতে চাই, মৃত্যু উপত্যকা আমাদের দেশ নয়…

Leave a Reply