হলি আর্টিজান বেকারি : এক নজরে ঢাকা অ্যাটাক

২০১৬ সালের পহেলা জুলাই, রাত প্রায় ৯টা। রাজধানীর সবচেয়ে অভিজাত এলাকার নামীদামী এক রেস্টুরেন্ট, নাম হলি আর্টিজান বেকারি । কূটনৈতিক পাড়ায় অবস্থান হওয়ার কারণে রেস্টুরেন্টে আগত কাস্টমাররা বেশিরভাগই বিদেশী। রেস্টুরেন্টের কর্মচারী ও কাস্টমারদের মধ্যে ৯ জন ইতালিয়ান, ৮ জন জাপানি, ১ জন শ্রীলংকান, ১ জন ইন্ডিয়ান এবং ১৪ জন ছিলেন বাংলাদেশী নাগরিক।

প্রতিদিনের নিয়মিত নীরবতা ভেঙ্গে সেই রাতে হলি আর্টিজানে প্রবেশ করে ৫ অজ্ঞাত যুবক। সবার হাতেই আধুনিক স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। ঢুকেই এলোপাথারি গুলি ছুঁড়ে অস্ত্রের মুখে মূহুর্তেই তারা রেস্টুরেন্টে উপস্থিত সবাইকে জিম্মি করে ফেললো। হতভম্ভ হয়ে গেলো নিরীহ জিম্মিরা যখন তারা ওই ৫ যুবকের দাবী জানতে পারলো। দাবী তাদের একটাই, কোরআনের আয়াত বলতে হবে। না পারলেই মৃত্যু ! দাবী অনুযায়ী ঘন্টাখানেকের মধ্যেই তারা একে একে ২০ জনকে ধাঁরালো অস্ত্রের মাধ্যমে গলা কেটে নৃশংস ভাবে হত্যা করলো। বাকি ১৩ জন আপাতত প্রানে বেঁচে গেলো। কিন্তু তাতে কি, বন্দীদশা থেকে তো তাদের নিস্তার নেই। কারণ ততক্ষণে বাইরে থেকে পুরো রেস্টুরেন্ট ঘিরে ফেলেছে পুলিশ বাহিনী, সাথে আছে মিডিয়ার লোকজন আর অসংখ্য উৎসুক জনতা। ৫ জঙ্গির পালিয়ে যাবার কোনো পথ খোলা নেই।

dhaka attack

ঘটনার এই পর্যায়ে আসুন জেনে নেয়া যাক ওই ৫ ভিলেনের পরিচয়। জেনে রীতিমত অবাক হতে হয় যে, তাদের সবাই বেশ সচ্ছল পরিবারের উচ্চশিক্ষিত যুবক। তাদের নাম নিবরাস ইসলাম, মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খাইরুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম। তাদের সাংগঠনিক ছদ্মনাম গুলো ছিলো যথাক্রমে রিপন, আকাশ, বিকাশ, বাঁধন ও ডন। এদের মধ্যে নিবরাশ মালেইশিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলো। সেখানে মন টিকেনি তার, তাই দেশে ফিরে এসে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলো। মোবাশ্বের স্কলাসটিকার ছাত্র আর রেহান ব্রাক ইউনিভার্সিটিতে পড়তো। বাকি দুইজনের পরিচয় সম্পর্কে কোনো বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পাওয়া যায়নি।

ফিরে আসি গুলশানে। ইতিমধ্যেই আইএস নামক জঙ্গি সংগঠন হলি আর্টিজান বেকারি -তে হামলার দায় স্বীকার করে নিয়েছে, এমনকি তাদের ওয়েবসাইটে হামলাকারী ৫ জঙ্গি ও নিহত ২০ জন জিম্মির লাশের ছবিও প্রকাশ করেছে। পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৫ জঙ্গিকে অবজ্ঞার চোখে দেখে তাদের বিরুদ্ধে অভিজানে নেমে পরলো পুলিশ বাহিনী। ফলাফল, ২ পুলিশ সদস্য নিহত এবং আরো ৮ জন গুরুতর আহত। হলি আর্টিজানের বাইরে তখন থমথমে পরিবেশ। নিউজ মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে ততক্ষণে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে এই হামলার খবর। জঙ্গিদের ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে শোকে ছেয়ে গেছে পুরো দেশ। নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই বিদেশী হওয়াতে কূটনৈতিক চাপে পরেছে সরকার।

Holey Artisan Bakery Dhaka Attack

সবাই তাকিয়ে আছে প্রশাসনের দিকে, কি করবে তারা? কিভাবে করবে? হলি আর্টিজানের ভিতরে তখন কি হচ্ছে? এখনো কি কেউ বেঁচে আছে? নাকি জঙ্গিরা সবাইকেই হত্যা করেছে? কি আছে ওই ৫ জঙ্গির ভাগ্যে? এমন হাজারো প্রশ্ন দেশ-বিদেশের লক্ষ কোটি আমজনতার মনে।

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নিরাপদ দুরত্বে অবস্থান নিয়ে সেই রেস্তোরাঁ ঘেরাও করে রয়েছে পুলিশ বাহিনী। পাশাপাশি হলি আর্টিজানের আশেপাশে ধীরে ধীরে সন্তর্পণে অবস্থান গ্রহন করছে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে দিক্ষিত প্যারা কমান্ডো বাহিনী। নিরাপদ দুরত্বের বাড়িগুলো থেকে প্রতিনিয়ত বাইনোকুলারের মাধ্যমে নজর রাখা হচ্ছে টার্গেট হলি আর্টিজানে। চেষ্টা চলছে ভেতরের পরিস্থিতি আঁচ করার। রাত তিনটার পরে একজন বন্দী অবস্থায় নিজের ফেইসবুক আইডিতে পোস্ট করলো সে সহ মোট ৮ জন একটা টয়লেটে আত্মগোপন করে আছে। ভোর ৬ টার পরপর রেস্তোরাঁর ছাদে তিনজন লোককে পায়চারি করতে দেখা যায়। এদের মধ্যে একজন অস্ত্রধারী, এবং বাকি দুইজনের হাত বাঁধা। বুঝা যাচ্ছে তারা দুজনেই ওই অস্ত্রধারীর হাতে জিম্মি। খানিকক্ষণ পর খুলে দেয়া হলো তাদের হাতের বাঁধন, এবং তারপরেই ভিতরে চলে গেলো তিনজনই। নিশ্চিত হওয়া গেলো এখনো কিছু জিম্মিকে প্রানে বাঁচিয়ে রেখেছে জঙ্গিরা।

Operation Thunderbolt Holey Artisan

সকাল সাতটার পরে সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী ও বিমান বাহিনীর যৌথ কমান্ডোরা শুরু করলো উদ্ধার অভিজান, অপারেশনের নাম দেয়া হলো “অপারেশন থান্ডারবোল্ট”। শ্বাসরুদ্ধকর এক অপারেশন। সকাল ৭টা ২৫ মিনিট। ঘটনাস্থলের চারপাশ থেকে অনেক আগেই সরিয়ে দেয়া হয়েছে সাধারণ জনগনকে। গণমাধ্যম কর্মীরাও অনেক দূরে। হঠাৎ সেনাবাহিনীর কয়েকটি জিপ থেকে নেমে আসলেন প্যারা কমান্ডোর সদস্যরা। একটার পর একটা ব্যাকআপ দল ক্রলিং করে এগিয়ে যাচ্ছে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁর দিকে। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে গর্জে উঠলো গুলি আর গ্রেনেডের শব্দ, একনাগাড়ে চলছে। ভেতর থেকে সংকেত এলো সাঁজোয়া যান পাঠানোর। একে একে নয়টি সাঁজোয়া যান। তারপর থেকে আবারো গুলি আর গ্রেনেডের শব্দ

কয়েক মিনিটের মাথায় একে একে বেরিয়ে এলেন কয়েকজন জিম্মি। প্রথমে আসলেন দুজন তরুণী। তাদের মাথায় হাত। দুই তরুণীর পর এক শিশু। তার পেছনেই নীল গেঞ্জি গায়ে এক ব্যক্তি। এরপর আরেক কিশোরী। কালো গেঞ্জি পরিহিত এক যুবক হাত তুলে দৌড়ে আসলেন। তার পেছনে পেছনে আরেক মধ্যবয়সী। তারও হাত ওপরে তোলা। সবার চোখে-মুখেই ভয়াবহ আতংক। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের নিয়ে গেলো পাশের এক বাসায়।

এদিকে পরক্ষণেই আবার শুরু হয় গোলাগুলি। গ্রেনেডের শব্দ। বিকট আওয়াজ। এর একটু পরই ভেতর থেকে বের করে আনা হলো একজনকে, গুলিবিদ্ধ ! রক্তাক্ত জামা। দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সে পাঠানো হলো তাকে হাসপাতালে। কিছুক্ষণ পরপরই আসছে গুলির আওয়াজ। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় বাইরে অপেক্ষা করছে সবাই।

কি হচ্ছে ভেতরে? অস্ত্রধারী জঙ্গিদের কি অবস্থা? জিম্মিরা সবাই জীবিত তো?

ডাক এলো বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের। র‌্যাবের চৌকস বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট প্রস্তুত ছিল পাশেই। তারা ঘটনাস্থলের দিকে ছুটে গেলেন। এভাবে কেটে গেলো প্রায় ৪৫ মিনিট। এক পর্যায়ে থেমে এলো গুলির আওয়াজ। বোঝা গেলো অপারেশন শেষ। অপারেশন থান্ডারবোল্ট শেষে মারা গেছে অস্ত্রধারী ৫ জঙ্গি (যদিও তাৎক্ষনিকভাবে অপারেশন শেষে বলা হয়েছিলো ৬ জন) এবং উদ্ধার করা হয়েছে ১৩ জিম্মিকে।

হলি আর্টিজান

হলি আর্টিজানের দেয়ালজুড়ে ভয়াবহতার ছাপ

মুসলিম ধর্মপ্রধান দেশে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঈদুল ফিতরের ঠিক ৫ দিন আগে ইসলামকে পুঁজি করে এমন একটা ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছিলো পুরো দেশ। হবেই বা না কেনো, দেশে যে এই প্রথম আইএস নামক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের দ্বারা কোনো হামলা হয়েছিলো। এর আগে তো কেউ ভাবতেই পারেনি যে এই দেশেও ওত পেতে আছে আইএসের সাঙ্গপাঙ্গরা। দেশের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি, অর্থাৎ মেধাবী তরুন-যুবকদের মগজধোলাই দিয়ে টেনে নিচ্ছে তাদের নিষিদ্ধ পথে। এমন শ্রেনীর ছেলেদের দলে ভিড়াচ্ছে, যাদের নেই কোনো অর্থাভাব। এমনকি নেই সঠিক শিক্ষারও কোনো অভাব।

তবু কিসের লোভে এই ছেলেগুলা তাদের জীবনের মায়া ভুলে, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজনের মায়া ভুলে এমন একটা আত্মঘাতি কাজের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলো ! কিসের লোভে নিজেদের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে, সামাজিক অবস্থান ভুলে গিয়ে বেপথে চলে গেলো !

সেদিন হামলাকারী ৫ জনকে হত্যা করাটাই কি এই ঘটনার সমাধান? নাকি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে দেশ থেকে একদম সমূলে বিনাস করতে হবে এই জঙ্গিবাদ ! সমাধানের পথ খুঁজতে গিয়ে প্রশ্ন এখন এগুলোই। আপাতদৃষ্টিতে সমাধান বলতে যে কয়টা কথাই বলা যায়, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। তরুণ যুবক ছেলেরা কখন কাদের সাথে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, কি ভাবছে এসবের প্রতি বাবা-মা’র নজর রাখতে হবে। যাতে করে আর কখনো কোনো বাবা-মাকে নিজের মৃত সন্তানের লাশ থেকেও ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিতে না হয়।

ধর্মীয় সুশিক্ষা দেয়ার বিষয়টাও কি এখানে উল্লেখ করা যায়? প্রশ্ন অনেক ! সমাধানের যে পথটা খুঁজছি, সে পথের শেষটাও বহুদুর ! খুব সম্ভবত…

বন্ধ হোক ধর্মের নামে চলমান সকল সহিংসতা। ধর্ম কোনো অস্ত্র নয়, বিশ্বাস এবং ভালোবাসার বস্তু !