অদ্ভুত সব মানসিক রোগ (পর্ব-২)

ভিন্নরকমের কিছু মানসিক রোগ নিয়ে আগের পর্বে আমরা কথা বলেছিলাম। এ পর্বে আমরা আরো কিছু নতুন  মানসিক সমস্যাগুলোর সাথে পরিচিত হবো, যেগুলোর প্রভাব আমাদের সবার মাঝেই কমবেশ রয়েছে !

চলুন জেনে নেয়া যাক অদ্ভুত সব মানসিক রোগ সমূহের নাম ও সংজ্ঞা –

ক্লিপ্টোমেনিয়া (Kleptomania)

আচ্ছা ধরুন আপনি দোকানে গেলেন। একটি জিনিস দেখে খুব পছন্দ হলো। আপনার কাছে টাকা থাকা না থাকা এখানে মুখ্য নয়। আপনি কি চুরি করার কথা ভাবতে পারেন? উত্তর খুব সম্ভবত না। এবং যদি ভেবেও থাকেন চারিদিকে লোকজন খুব সহজে দেখে নিবে এমন। চক্ষুলজ্জার জন্য হলেও আপনি জিনিসটি চুরি করতে পারবেন না।

Kleptomania

কিন্তু অনেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ধরা পরার ভয় না পেয়ে এবং জিনিসটা কেনার মত পর্যাপ্ত সামর্থ থাকা সত্ত্বেও তারা জিনিসটা চুরি করে ফেলে। এমনকি জিনিসটা হতে পারে মাত্র কয়েক টাকার একটা লিপস্টিক মাত্র। এমনকি এমনও ঘটনা আছে যেখানে, যে জিনিসটা সে চুরি করেছে সেটি তাঁর দরকার অব্দি পড়ে না।

ব্যাপারটা যখন এমন তখন সেটা নিশ্চয় আর স্বাভাবিক বলা চলে না। এটি একটি মানসিক রোগ নাম ক্লিপ্টোম্যানিয়া। সাধারণ ভাবে যদি বলতে হয় তাহলে বলা চলে, অকারণে চুরি করার প্রবণতা। এই রোগের প্রবণতা ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের মধ্যে প্রকট !

Kleptomania রোগটি সর্বপ্রথম ১৮১৬ সালে Impulse control disorder নামে বর্ণনা করা হয়।

বিখ্যাত শিল্পী ব্রিটনি স্পিয়ার্স কিংবা অভিনেত্রী লিন্ডসে লোহানকে কে না চেনে। তারা দুজনেই এ রোগে আক্রান্ত। লিন্ডসে লোহান একবার ২৫০০ ডলারের একটি নেকলেস চুরির দায়ে ধরা পড়েছিলো। এছাড়াও এর আগে এবং পরে নানান দোকান থেকে জুতো, ড্রেস ইত্যাদি কয়েকবার সে চুরি করেছিলো। এর জন্য লিন্ডসে লোহান কে রিহ্যাব অব্দি যেতে হয়েছিলো। একবার তো অভিনেত্রী মেগান ফক্স মাত্র ৭ ডলারের একটি লিপ গ্লোস চুরির জন্য ধরা পড়েছিলো।

ব্যাপারটা তেমন বড় কিছু মনে না হলেও অবাক করার মত ব্যাপার হলো, পৃথিবীর ০.৬ শতাংশ মানুষ এই ক্লিপ্টোম্যানিয়া রোগে আক্রান্ত। আর এই ক্লিপ্টোম্যানিয়া রোগের জন্য প্রতিবছর প্রায় পৃথিবী জুড়ে ব্যবসায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। ভাবা যায় !

গ্যামোমেনিয়া (Gamomania)

ধরুন আপনি রাস্তায় হেটে যাচ্ছেন। এমন সময় একজন হুট করে আপনাকে বিয়ের জন্য প্রস্তাব দিয়ে বসলো। আপনি তাকে চেনেন না, এমনকি কখনই দেখেনও নি। তো আপনি হতচকিয়ে গেলেন। সেটাই স্বাভাবিক। মজার ব্যাপার হলো, যে আপনাকে প্রস্তাব দিলো, সে নিজেও আপনাকে কখনই চেনে না। এমনকি এটা প্রাংকও ছিলো না। কি? ঘাবড়ে গেলেন?

তবে শুনুন, এটা একটা মানসিক রোগ, নাম “Gamomania”! এই রোগে আক্রান্ত মানুষ প্রস্তাব দেয়ার উপর অবসেসড। একই সাথে অনেক জনকে প্রস্তাব দিয়ে থাকেন। অপরিচিত না হলেও স্বল্প পরিচিত বা পরিচিত তবে ঠিক তাঁর সাথে ব্যাপারটা ওইভাবে প্রস্তাব অব্দি যায়না, এমন কাউকেও তারা প্রস্তাব দিয়ে থাকেন। হাস্যকর শোনালেও এমনটা পুরোপুরোই সত্য।

এখন আপনাদের, বিশেষ করে মেয়েদের ইনবক্সে অপরিচিত মানুষ বিয়ের জন্য প্রপোজ করে থাকেন হুট করে। জানা নেই শোনা নেই তবুও। এটাও ওই রোগের অংশ কিনা, সেটা চিন্তার বিষয়। তবে না হওয়াও অস্বাভাবিক না !

সেলিব্রিফিলিয়া (Celebriphilia)

শাহরুখ খানের “ফ্যান” সিনেমাটি তো অনেকেরই দেখা। সেখানে হয়কি, একজন সিনেমা তারকা নাম ‘আরিয়ান খান্না’। তার একজন পাগলাটে ফ্যান থাকে, নাম গৌরব। সিনেমায় গৌরব নিজেকে আরিয়ান খান্না বলে পরিচয় দিত এবং সকল কর্মকাণ্ড আরিয়ান খান্নার হুবহু নকল করত। শেষে এক খারাপ পরিণতি দাঁড়ায় এই পাগলাটে ফ্যানের।

প্রায়সই নানান জায়গায় এরকম খবর দেখতে পাওয়া যায়। এটি একটি একধরণের অদ্ভুত মানসিক রোগ। নাম “Celebriphilia”।

সাধারণ ভাষায় যাকে বলে, তারকাদের প্রতি প্রচন্ড রকম আকর্ষণ বা অবসেসন। এই রোগটি এতটাই প্রবল হতে পারে যে ওই সেলেব্রেটির জন্য সে মৃত্যুকে বেছে নিতেও দ্বিধা বোধ করেনা। সেলিব্রেটির মৃত্যু কিংবা বিয়েকে কেন্দ্র করে সে মৃত্যুকে বেছে নিতে পারে।

যেমন, পপসম্রাট মাইকেল জ্যাকসনের মৃত্যুতে আমেরিকাতে ডজন খানেক মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
আবার ব্রিটিশ বিখ্যাত ব্যান্ড One Direction এর শিল্পী জেইন মালিক ব্যান্ড ছেড়ে দেয়াতে ৬ জন্য আত্মহননের পথ বেছে নেয় এবং অনেকেই হাত কেটে অনলাইনে পোস্ট করে জেইন মালিককে ব্যান্ডে ফিরে আসার অনুরোধ করে।

প্যারিস সিনড্রোম (Paris Syndrome)

আমাদের সবার মাঝে এমন অনেক বন্ধু আছে, বিশেষ করে মেয়েরা যারা কিনা তাঁর জীবনে একবার হলেও প্যারিস যেতে চায়। সেটা যেকোনো কিছুর বিনিময় হোক। তারা প্রতিদিন অন্তত একবার হলেও কাউকে না কাউকে বলে বসে, একবার হলেও প্যারিস যেতে চাই। একবার।

এরকম পাগলামো যখন মাত্রা ছাড়ায় তখন সেটা অস্বাভাবিকের পর্যায় পরে। আর তাই এটি একটি আজব রোগ। নাম হচ্ছে “Paris Syndrome.”

এই রোগের ধারনা আসে জাপান থেকে। সেখানে দেখা যায়, প্যারিস যাবার জন্য পাগলাটে ব্যবহার করা অনেকের আবার প্যারিস সম্পর্কে ধারনাই নেই। একটু খেয়াল করে খুঁজলেই এই রোগী আমাদের মাঝেই পাওয়া যাবে।

বোনথ্রোপী (Boanthropy)

ধরুন আপনি মাঠের এক কোনায় আরাম করে বসে আছেন আর বাদাম চিবোচ্ছেন। অল্প দূরে একটি গাছ। গাছের ঠিক পাশে আবিষ্কার করলেন কেউ একজন ঘাস চিবুচ্ছেন। ঠিক যেমন গবাদিপশুরা খেয়ে থাকে। আপনি কিছুটা হতচকিয়ে গেলে। সেটাই স্বাভাবিক। আপনি নিশ্চয় তাকে আর স্বাভাবিকের কাতারে ফেলবেন না। ফেলার কথাও না।

হাস্যকর শুনালেও, এটি একটি মানসিক রোগ। নাম হচ্ছে, “Boanthropy.”

এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় অনেক অনেক কাল আগে। খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ ৬০০ অব্দের দিকে। তখন সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন। সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার হচ্ছে ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যানের স্রষ্টা এবং প্রাচীন জেরুজালেমের মন্দির তিনিই ধ্বংস করেন। উল্লেখ আছে, তিনি, গরুর মত করে ঘাস খেতেন।

পার্কে গিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করলে ‍একদিন কাউকে ঠিকই পেয়ে যাবেন, যে কিনা এমন অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত।

মাইক্রোসিয়া সিনড্রোম (Micropsia Syndrome)

micropsia syndrome

এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তি এর স্থান, কাল, পাত্রের জ্ঞান লোপ পায়। তারা সব কিছুকে অন্যরকম করে দেখে। সব কিছুকে বড় দেখে। সব কিছুর মাঝে আকৃতিতে অসামঞ্জস্য দেখে। এমনকি তারা তাদের নিজেদের হাত পা ইত্যাদিকেও বড় কিংবা ছোটো আকৃতির দেখে। এটি একটি হ্যালুসেশন কেন্দ্রিক মানসিক রোগ। মানসিক রোগের পরিভাষায় একে লিলিপুট হ্যালুসিনেশন সিনড্রোম বা এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড সিনড্রোম বা লিলিপুট সাইট সিনড্রোমও বলা হয়।

ডিজনির “এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড” সিনেমাটি যারা দেখেছেন, তারা ভালোভাবে বুঝতে পারবেন।

Leave a Reply