সত্যিই কি ফিকশনাল ক্যারেক্টারের প্রেমে পরা যায় ?

প্রেম বা ভালোবাসার বিভিন্ন ধরন থাকতে পারে। কেউ বলছে ‘আমি আমার মাকে ভালোবাসি, আমি আমার বোন কে ভালোবাসি, আমি আমার হবু বর/বধুকে ভালোবাসি’ অথবা ‘আমি আমার বিড়ালকে ভালোবাসি’। প্রতিটি সময় কিন্তু ভিন্ন অর্থই বোঝানো হচ্ছে ভালোবাসার। মেরিয়াম ওয়েবস্টার (Merriam Webster) অনুযায়ীও মিউজিক, ফুড, প্রিয় জায়গা এসব জিনিসগুলোর জন্য স্বতন্ত্রতার আলাদা সংজ্ঞা রয়েছে।

বই, চলচ্চিত্র, টিভি শো ইত্যাদির কাল্পনিক সব চরিত্র সেই শেষ সংজ্ঞাটি আরো এগিয়ে নিয়ে যায়। ‘আমি লাবণ্যকে ভালোবাসি (শেষের কবিতা থেকে)’, ‘আমি হারলি কুইনকে ভালোবাসি (সুইসাইড স্কোয়াড থেকে)’, ‘আমি চ্যান্ডলারকে ভালোবাসি (ফ্রেন্ডস থেকে)’ কিংবা ‘আমি আরিয়া স্টার্ককে ভালোবাসি (গেইম অফ থ্রোন্স থেকে)’। এই প্রত্যেকটা কাল্পনিক চরিত্র অবশ্যই সাধারণ ব্যাক্তি না, তারা সত্তাহীন। কারণ তারা শুধুমাত্র একটি ধারনা।

কিন্তু তাদের জন্য মানুষের ভালোবাসা একদম বাস্তব মানুষদের প্রতি ভালোবাসার মতই হতে পারে, তখন এটা
কি স্বাভাবিক প্রেম? এটা কি অন্যসব প্রেমের গল্প থেকে ভিন্ন? যদি এই অনুভুতি গুলো কোনভাবেই প্রতিস্থাপন না করা যায়, তাহলে কি এটা “বাস্তব” প্রেমের মানুষ, পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং গুরুত্বপূর্ণ অন্যদের মতই হতে পারে? আর সত্যি সত্যিই যদি এমন হয়, তখন কি হবে?

কাল্পনিক চরিত্রের প্রেমে সত্যিই পরা যায় কিনা এর অর্থ খুজতে গেলে “সত্যিকারের প্রেম” এর আসল অর্থ পাওয়া যায়। গ্রিকরা মেরিয়াম ওয়েবস্টার (Merriam Webster) এর চেয়েও এগিয়ে গিয়েছিল। তাদের অন্তত সাতটি ভিন্ন শব্দ রয়েছে যা ইংরেজিতে Love এর অনুবাদ করে, প্রতিটি আলাদা ঘটনার জন্য।

Philautia : ফিলোয়াটিয়া হচ্ছে স্ব-প্রেম। এটা স্পষ্টভাবেই বাস্তব মানুষ এবং কাল্পনিক চরিত্রের প্রতি ভালোবাসার জন্য প্রযোজ্য নয়।

Pragma : প্রগমা হচ্ছে এরেঞ্জ ম্যারেজ কিংবা তা সম্পর্কিত কারনগুলোর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ভালোবাসা। বাস্তব মানুষদের নিশ্চই কাল্পনিক চরিত্রের সঙ্গে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ এর মত করে সম্পর্ক করে দেয়া হয়না। তার মানে প্রগমাও বাদ দেয়া যায়।

Ludus : লুডাস হচ্ছে এমন প্রেম যে সম্পর্কের দুজন নিজেদের মধ্যে টান অনুভব করে না কোন। মানে বাধাধরা না এমন। Psychology Today অনুযায়ী লুডাস শব্দটা তখন ই প্রযোজ্য যখন দুজন ই স্ব-নির্ভরশীল থাকে নিজেদের দিক থেকে। কাল্পনিক চরিত্র গুলো সবসময়ই তাদের অস্তিত্বের জন্য লেখকদের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং এই টার্ম টিও বাদ দিতে পারি আমরা।

Eros : শারীরিক আকর্ষণের জন্য মানুষকে তাদের আবেগ অনুভুতি এবং কখনো কখনো আরো অদ্ভুত বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে পরিচালিত করে, সেটাকে ইরোস বলা হচ্ছে। মানুষ কখনো কখনো অভিনেতার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তার চরিত্রকে ভালোবেসে ফেলে। যেমন ধরা যাক কেউ বলছে সে শারলককে ভালোবাসে, সে আসলে শারলক হোমসকে ভালোবাসে না, ভালোবাসে এর অভিনেতা বেনেডিক্ট কামবারব্যাচ’কে।

Philia : ফিলিয়াকে আদর্শ বন্ধুসুলভ প্রেম বলা যেতে পারে। ইরোস যখন শারীরিক কামনা, ফিলিয়া তখন একে অপরকে বোঝার একটি বাসনা। অ্যারিস্টট্লের বর্ণনা অনুযায়ী, ফিলিয়াসটি বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে যে, আপনি যাকে ভালোবাসেন সে আপনার অবশ্যই পছন্দীয়, ধার্মিক কিংবা অনেক গুনের অধিকারী, ইত্যাদি। এই বর্ণনা টা উপযোগী বলা যায়। কেননা ফিকশনাল ক্যারেক্টার গুলো কখনো কখনো এমন হয়, ঠিক আমাদের পছন্দমত। তাদের নিজেদের যথেষ্ট গুনাবলী লক্ষনীয় থাকে। আবার দেখা যায় যে চরিত্র গুলো এমন নাহ, তাদের অনেক্সময় ঘৃণা করছি আমরা। এই পরিস্থিতি গুলো ফিলিয়া দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।

Storge : এটা পারিবারিক ভালোবাসা। পরিবারের মানুষজন একে অপরকে নিশ্চই আগের উল্লেখিত কোন কারনেই ভালোবাসে না। তারা ভালোবাসে কারন তারা একসাথে বড় হয়ে হয়েছে তাই। কাল্পনিক চরিত্র গুলোও দেখা যায় তেমনি, মনে হয় যেন চোখের সামনেই বড় হচ্ছে। কোন চরিত্রের মৃত্যু কেও মাঝে মাঝে খুব আপন কারো মৃত্যু মনে হয়। আমরা জেনে বা না জেনেই অনেক চরিত্র কে নিজের আপনজন মনে করে ফেলি,
আর তাদের মৃত্যু তে বাস্তব কোনো মানুষের মৃত্যুর মতই কষ্ট পাই। হ্যারি পটার সিরিজের লেখিকা জে. কে. রোওলিং বলেছিলেন যে তিনি হ্যারি পটারের অনেক চরিত্রের মৃত্যু লেখার সময় নিজেই কা‍ঁদছিলেন।

Agape : এটা হচ্ছে অপরিচিত কারো জন্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। সব মানুষই যে বাস্তবে অন্যজনকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসেন তা কিন্তু না। কিন্তু ফিকশনাল ক্যারেক্টার এর জন্য ভালোবাসার জন্য এটা যৌক্তিক। ভক্তরা তাদের প্রিয় কাল্পনিক চরিত্রের সেরা স্বার্থের জন্য কিংবা সেই চরিত্রের সবচেয়ে ভালো এন্ডিং এর জন্য একটা সত্যিকারের আকাংখা অনুভব করতেই পারেন। যদি ভালোবাসা হয় অবশ্যই সেটা নিঃস্বার্থ ভালোবাসা , কারণ ওই চরিত্রটা নিশ্চয়ই বিনিময়ে কিছু দিতে পারছেনা।

সুতরাং কেউ বলছে ‘আমি আলাদিন কে ভালোবাসি’, এটার চারটা সম্ভাব্য অর্থ থাকতে পারে।

  • হতে পারে আমি এই কার্টুন এর অংকন এর প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছি (ইরোস)
  • হতে পারে এই ব্যাক্তিকে আমি সৎ মনে করেছি, তাই ভালো লাগছে, এবং আমি আরো জানতে চাচ্ছি তার ব্যাপারে (ফিলিয়া)
  • হতে পারে বছরের পর বছর ধরে তার প্রতি আমার আগ্রহ তৈরী হয়েছে (স্টোরগ)
  • হতে পারে আমি এই চরিত্রের শেষ টা অবশ্যই ভালো কিছু চাই (এগেপ)

বোঝা যাচ্ছে যে, ফিকশনাল ক্যরেক্টার এর প্রতি প্রেমটা এই কতিপয় অনুভুতিগুলোরই সমন্বয় হবে।
শুধু এটুকুই আবার বলা যাচ্ছে না। কারণ কেবল ‘প্রেম’ শব্দ টাকেই ব্যাখ্যা করার জন্য পৃথিবীতে অনেক কিছু
আবিস্কার করা হয়েছে। ঠিক তার পরই আসছে আবার প্রেমের প্রভাব। কাল্পনিক চরিত্রের প্রেমে না হয় পরা গেলো।
কিন্তু এই প্রেমের প্রভার বাস্তব জীবনে কিভাবে পরছে, এটা ছোট ব্যাপার নয়।

কেউ যখন একটা রিয়েল-লাইফ স্টোরীতে ঢুকে, তখন ফিকশনাল স্টোরী গুলো অনুরাগী স্মৃতির মত মনে হবে।
কারণ রিয়েল লাইফের ক্যারেক্টার গুলো কে তার যখনই দরকার হবে তখনই পেতে পারবে।

Leave a Reply