আলোর ভুবন স্কুল : একজন স্বপ্নবাজের গল্প

সম্প্রতি ঢাকার সাত কলেজের আন্দোলনে চক্ষু হারানো সিদ্দিকুরের জন্য চক্ষুদানে আগ্রহী হয়ে দেশের স্বনামধন্য কিছু পত্রিকার শিরোনাম হয়ে আলোচনায় আসেন মোঃ জাহাঙ্গীর কবির(২৪)। তিনি ১৯৯২ সালের ১০ জুলাই টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার জাঙ্গালিয়া নামক গ্রামে একটি অস্বচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অভাব অনটনের মধ্যেও স্বিয় ইচ্ছায় গ্রামের স্কুল,কলেজ থেকে যথাক্রমে SSC, HSC শেষ করার পর উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্য ঢাকায় আসেন। এরপর তিনি ঐতিহ্যবাহী কলেজ ঢাকা কলেজে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য ভর্তি হন। কিন্তু স্বপ্নবাজ কবির তার স্বপ্নের আলোর ভুবন স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য এক বছরের মাথায় উচ্চতর শিক্ষাকে বর্জন করতে দ্বিধাবোধ করেননি। গায়ে খেটে পরিশ্রম করেও যোগাতে হয়েছে বাচ্চাদের চক, ডাস্টার ও বই-খাতার দাম। অবৈতনিক প্রতিষ্ঠানটি অনেক চড়াই উতরাই এর পর আজকে অন্ধকারে আলোর মশাল জ্বালাতে সক্ষম। বর্তমানে তিনি বেসরকারি মকবুল হোসেন ডিগ্রী কলেজে BSS (ব্যাচেলর অব সোস্যাল সাইন্স, স্নাতক) ডিগ্রী ২য় বর্ষে অধ্যায়নরত আছেন। জেনে নিবো স্বপ্নবাজ জাহাঙ্গীরের সেই স্বপ্নের গল্প ও সফলতা তার মতো করে….

২০০৭, এক বেসরকারি জরিপে দেখা গেলো মধুপুরের দক্ষিণ জাঙ্গালিয়ার আশেপাশের গ্রামের প্রাথমিক শিক্ষার হার মাত্র ১০%। মাত্র ১০% প্রাথমিক শিক্ষার হার। নিঃসন্দেহে আঁচ করা যায় এই গ্রামের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার হার কতটা ভয়াবহ পর্যায়ে রয়েছে । ধরেই নেয়া যায় ০% । ০% শিক্ষার হার একটি অঞ্চলের জন্য সকল কিছুর অন্তরায়। বিদ্যুৎ নেই , যাতায়াতের সুব্যবস্থা নেই , বিদ্যালয় নেই , সচেতন মানুষ নেই ইত্যাদি নানা সমস্যায় এই গ্রাম যে আগামী দিনের প্রতিযোগীতায় অযোগ্যতার প্রমাণ দিবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা । আমাদের অবশ্যই এই দুর্বিসহ অবস্থান থেকে উত্তরণের পথ খোঁজতে হবে । ভাবনা একটাই। যেকোন ভাবে শিক্ষার প্রসার করতেই হবে । এতো বড় গ্রাম অথচ ৭/৮ কিমি পরিধির মধ্যে কোন বিদ্যালয় নেই ।

উদ্যোগটা যেহেতু কাউকে না কাউকে নিতেই হবে তাই আমিই উদ্যোগ নিলাম। পরিকল্পনা হলো বনাঞ্চলের শিশুদের জন্য আমরা একটি বিদ্যালয় খুলবো । একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বন্ধুদেরক সঙ্গে নিয়ে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আগানো হলো । ক্লাসের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা না পেয়ে আনন্দ বাজারের রাস্তার পাশের পরিত্যক্ত ঘরগুলি বেছে নেয়া হলো । বাড়ী বাড়ী গিয়ে ছাত্র খোঁজা শুরু হলো । একজন দুইজন করে করে ছাত্রছাত্রীও বাড়তে থাকলো । গ্রামের ছাত্র সংগঠন নব দিগন্তের সহযোগীতায় কিছু পুরাতন আসবাব পত্রের ব্যবস্থাও হলো । চক ডাস্টার খাতা পত্র কেনার জন্য ছাত্রদের অল্প টাকা বেতনও ধরা হলো । নবদিগন্তের নামেই কিছুদিন চলল বিদ্যালয়টি । বিনা পারিশ্রমিক বিধায় স্কুল থেকে শিক্ষকরা একে একে সবাই চলে যেতে লাগলো । কিছুদিন পর আর্থিক সঙ্কট , শিক্ষক সঙ্কট ,স্বেচ্ছাসেবক সংকটে বিদ্যালয়টি একরকম বন্ধই হয়ে গেলো । পড়াশোনার দরুন তরুণরা বিভিন্ন জায়গায় চলে যাওয়ায় একজন স্বেচ্ছায় বিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিতে চাইলেন । বিনা পারিশ্রমিক বিধায় তিনিও অল্প কয়েকদিন পর চলে গেলেন । মালিকের প্রয়োজন হওয়ায় ২০১০ সালের শেষ দিকে ক্লাস নেয়া পরিত্যক্ত দোকানগুলিও ছেড়ে দিতে হলো । এ পর্যায়ে এসে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধই হয়ে যায় ।

দীর্ঘদিন বিদ্যালয়ের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমি মর্মাহত হই । নতুন করে স্বপ্ন দেখি, সংকল্পবদ্ধ হই খোলা আকাশের নিচে হলেও আবার বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলবে । বিদ্যালয় পরিচালনার এক কঠিন যুদ্ধে আমি অবতীর্ণ হলাম । মাঝে মাঝে ভাবতে ভাবতে আমি দিশেহারা হয়ে যেতাম । কিভাবে আমি এই প্রতিষ্ঠান চালাবো ? কে যোগান দিবে , কে জমি দিবে , কে সাহস দিবে ? দিন মজুর পিতার সন্তান হয়ে একটা স্কুল চালানোকি সম্ভব ? শুরু হয় সংগ্রামী পথচলা। কলেজে ক্লাস করার পাশাপাশি বিদ্যালয়ের যোগানের জন্য ছুটির দিনগুলিতে আমি লজ্জা শরম ভুলে প্রায়ই দিনমজুরের কাজ করতাম । সে সময় একদিন মজুর খাটলে পাওয়া যেতো মাত্র ৪০ টাকা । এভাবে ৪০/৫০ টাকা করে জমিয়ে আমি প্রায়ই বিদ্যালয়ের ছোট ছোট যোগান মিটাতে চেষ্টা করতাম । কয়েকদিন বেশি ছুটি থাকলে আমি চলে যেতাম পাশের কোন উপজেলায় ইট ভাঙ্গতে বা রাজ মিস্ত্রির জোগালী হিসেবে কাজ করতে । আমি যে কাজই করতামনা কেন , যেখানেই থাকতাম না কেন আমার ভিতর বাহিরজুড়ে শুধু স্কুলের চিন্তাই কাজ করতো। স্কুলের কাজ আমাকে নেশার মত টানতো । এজন্য হাজার হাজার অপবাদ সইতে হতো আমাকে।

পরিবার তথা দেশের মানুষের কাছে পাগল আখ্যা শুনতে হতো। এতো কিছুর পরও আমার মাথায় একটাই চিন্তা, যে করেই হোক এই বনাঞ্চলের শিশুদেরকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতেই হবে । এভাবেই ঝড় আসে , ঝঞ্ঝা আসে, আমাদের ছুটে চলা থেমে থাকেনা ।

দীর্ঘ দুই বছর আমরা রাস্তার উপরে পলিথিনের ছাউনিতে ক্লাস নিলাম । ঝড়ের দিনে প্রায়ই সে ছাউনি তছনছ হয়ে যেতো । প্রতিবার ঘর ভেঙ্গে যাওয়ার পর মনে হতো এইবার মনে হয় আর এগুতে পারলাম না। কিন্তু সকাল হলেই শিশুদের কথা মনে হলে আবার সবাই মিলে ঘর ঠিক করতাম। বৃষ্টির দিনে একটাই ভয়, কখন জানি বৃষ্টিতে বাচ্চাদের বইগুলি ভিজে যায়। ঝড়ে ঘরটা উড়িয়ে নিয়ে গেলে আমরা ক্লাস নিতাম কারো চায়ের দোকানে বা কারো বাড়ির বারান্দায় । ক্লাস নিতাম কারো পরিত্যক্ত ঘরে বা কারো উঠোনে । ক্লাস নিতাম ফেলে রাখা কোন ক্লাব ঘরে বা ভাঙ্গা দোকানে । ক্লাস নিতাম রাস্তায় রাস্তায়, আজ এখানে কাল ওখানে ।

দীর্ঘ চার বছর পর আমরা অল্প একটু স্থায়ী জায়গা পাই। আব্দুস সাত্তার নামে এক ব্যক্তি একটুকরো জমি দেন স্কুলের জন্য। নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে সেখানে পা রাখার জায়গা পেলেও ঘর নির্মাণ করে ক্লাস নিতে সময় লেগেছিল আরো বহুদিন । একেবারে নিচু, খাদি জমি হওয়ায় মাসের পর মাস দিনে রাতে মাটি কাটতে হয়েছে নিজেদের মাথায় করে । সেই দুর্বিষহ স্মৃতি কোনদিন ভুলে যাওয়ার নয়।

১১ সালে আমাদের প্রথম ব্যাচ ৫ম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়। তারপর ১২ সালে নিজেদের অর্থায়নে আমরা একটি বিদ্যালয় ঘর নির্মাণ করি। বিদ্যালয় গৃহ নির্মাণের জন্য আমরা বাড়ি বাড়ি থেকে বাঁশ খুটি চেয়ে আনি। এভাবে একটি ঘর তৈরি হয়। শ্রম ঘাম ত্যাগ আর প্রচেষ্টায় আমরা গড়ে তুলি সম্পূর্ণ অবৈতনিক একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, “আলোর ভুবন আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়” যেখানে শিশু শ্রেণি থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত শিশুরা শিক্ষার সুযোগ পাবে । যুদ্ধ থেমে নেই, চলছে নিরন্তর সেই রণাঙ্গনে। আমরা আসলাম, অনেক পথ পেরিয়ে অনেক দূর। আমাদের এই কাজটিতে সমর্থন ও সহযোগীতা ছিল বন্ধু বান্ধবের, শিক্ষক,শিক্ষিকার, শুভাকাঙ্ক্ষী ও পরিচালনা পর্ষদের । দীর্ঘ এই যাত্রা পথে ক্রমে ক্রমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। এই পর্যন্ত আমরা অনেক নিবেদিতদের পেয়েছি যাদের ১০০ টাকা ২০০ টাকা সহযোগীতার কারনেই আজকের এই আলোর ভুবন এতোদূর এসেছে ।

সংগ্রামের এই দশ বছরে আমাদের নিবেদিত সহযোদ্ধারা যুক্ত হয়ে এই কাজকে বেগবান করেছে । তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ত্যাগ তিতিক্ষা এবং সহযোগীতার জন্যই এই আন্দোলন সফল হয়েছে । তাদের জন্যই আমাদের ছেলে মেয়েরা আজ মহাবিদ্যালয়ে পদার্পণ করেছে। আমি বিশ্বাস করি তাদের ত্যাগের কথা এই দেশের আগামী প্রজন্ম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে ।

বিশ্বাস করি তরুণদের হাত খরচের টাকায় পরিচালিত সম্পূর্ণ অবৈতনিক এই প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বাংলাদেশের একটি শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে সমাদৃত হবে এবং এই বিদ্যালয়ের প্রত্যেকটা ছাত্রছাত্রী একেকটি আলোকবর্তিকা হয়ে পৃথিবী থেকে অন্ধকার দূর করার যুদ্ধে শামিল হবে । পরিশেষে প্রত্যেকের প্রতি আবারো আমার বিনম্র শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা ।

একজন স্বপ্নবাজের গল্প এখানেই শেষ। তবে স্বপ্নবাজের স্বপ্ন দেখা এবং বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মৃত্যু শেষ হবার নয়।

Leave a Reply