বিশ্বখ্যাত কিছু সাহিত্যিকদের আত্মহত্যা

আত্মহত্যার সবচেয়ে প্রচলিত কারণটি হলো মানসিক চাপ ও বিষাদগ্রস্ততা। এছাড়াও আত্মঘাতী স্বভাব, নেশায় আসক্তি, দীর্ঘদিন অনিরাময়যোগ্য রোগে ভোগা সহ বিভিন্ন কারণে মানুষ আত্মহত্যা করেন। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ‘একজন সাহিত্যিকের আত্মহত্যা আর একজন সাধারণ ব্যক্তির আত্মহত্যা কখনই এক নয়!’ তবে পরিণতি একটাই, ‘মৃত্যু’!

আসুন আজকে জেনে নিই বিশ্বখ্যাত কিছু সাহিত্যিকদের আত্মহত্যা সম্পর্কে !

অ্যান সেক্সটন

অন্যান্য কবিরা যে বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতেন, নোবেলজয়ী অ্যান সেক্সটন সে বিষয়গুলোই তুলে আনতেন নিজের লেখায়। হস্তমৈথুন, রক্তঃস্রাব, গর্ভপাত ইত্যাদি বিষয়ও সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে তার কলমে। কিন্তু জীবনের বেশিরভাগ সময় মানসিক অস্থিরতার শিকার ছিলেন অ্যান। হতাশাগ্রস্ত হয়ে মদ্যপানের দিকে ঝুঁকে পড়েন একসময়। বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু প্রতিবারই বিফল হতে হয় তাকে।

অ্যান নিজের সর্বশেষ কবিতার পাণ্ডুলিপি একজন রিপোর্টারকে দিয়ে বলেছিলেন – ‘তার মৃত্যুর আগে যেন এটা প্রকাশিত না হয়।’ ১৯৭৪ সালের ৪ অক্টোবর গাড়ির মধ্যে কার্বন মনো-অক্সাইড গ্যাস ছেড়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে

আধুনিক মার্কিন সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ বলা হয় আর্নেস্ট হেমিংওয়েকে। তার নোবেল বিজয়ী উপন্যাস ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ গোটাবিশ্বে ব্যাপকভাবে সুখ্যাতি কুড়িয়েছে। এত খ্যাতিমান হয়েও তিনি অজানা মানসিক অশান্তিতে ভুগতেন। ১৯৬১ সালে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। অথচ তিনি বলে গেছেন – ‘মানুষ কখনই পরাজয় বরণ করে না। প্রয়োজনে লড়াই করতে করতে ধ্বংস হয়ে যাবে।’

প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে !

হান্টার এস থম্পসন

সর্বকালের অন্যতম সেরা ঔপন্যাসিক বলা হয় আমেরিকান বংশোদ্ভূত লেখক হান্টার এস থম্পসনকে। তার শেষ লেখাটির নাম ছিল ‘ফুটবল খেলার মৌসুম শেষ’, যা ছিল তার স্ত্রী অনিতাকে উদ্দেশ্য করে লেখা। এতে তিনি লিখেন –

‘আর কোনো খেলা নেই। আর কোনো বোমা নেই। চলতে থাকা নেই। কোনো মজা নেই। সাঁতার কাটা নেই। ৬৭, ৫০ এর পরও ১৭টি বছর। আমার চাওয়ার অথবা দরকারের চেয়েও ১৭টি বাড়তি বছর। বিরক্তিকর। আমি সব সময়েই উদ্দাম। কারও জন্য কোনো আনন্দ নেই। ৬৭, তুমি লোভী হয়ে যাচ্ছো। বুড়োমি দেখাও। শান্ত হও, এটা ব্যথা দেবে না।’

এই লেখার মাত্র চার দিন পর গুলি করে আত্মহত্যা করেন থম্পসন। হয়ত অনেক দিন ধরে শারীরিক বিকলাঙ্গতায় ভোগার ফলেই আত্মঘাতী হন তিনি।

এডগার অ্যালান পো

এডগার অ্যালান পো ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক ও সম্পাদক। প্রতিভাবান এই লেখকের সারা জীবন কাটে অভাব, অনটন ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে। তিনি মদ ও জুয়ায় আসক্ত ছিলেন। খামখেয়ালি জীবনযাপন করতেন।

১৮৮৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান তিনি। ছয় দিন পর বাল্টিমোরের রাস্তায় পো’র নিথর দেহ পেয়ে, আশেপাশের লোকজন তাকে বাল্টিমোর হাসপাতালে নিয়ে যান। এর চার দিন পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ লেখা ছিল – ‘মানসিক বিষণ্নতা থেকে আত্মহত্যা’ !

ভার্জিনিয়া উলফ

ভার্জিনিয়া ছিলেন ইংরেজি ভাষার বিখ্যাত কবি। তার বিখ্যাত উক্তি – ‘নারী যখন ফিকশন লিখে, তখন তার একটি কক্ষ আর কিছু অর্থ খুব প্রয়োজন।’ ৫৯ বছরের উলফ মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। তিনি অনেকদিন ধরে ‘ডিপোলার ডিজঅর্ডার’ এ ভুগছিলেন।

১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ অদ্ভুতভাবে আত্মহত্যা করেন তিনি। ওভারকোটের পকেটে নুড়ি বোঝাই করে হেঁটে খরস্রোতা পাথুরে নদীতে নেমে গিয়েছিলেন উলফ। স্বামীকে উদ্দেশ্য করে লেখা তার সুইসাইড নোটটি ছিল-

‘আমি নিশ্চিতভাবে অনুভব করছি যে, আমি আবার পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমি অনুভব করছি যে, ওরকম আরেকটি ভয়াবহ সময়ের ভিতর দিয়ে যেতে পারব না আমরা এবং আমি এবার সেরে উঠব না। আমি কণ্ঠ শুনতে আরম্ভ করেছি।’

জন কেনেডি টুল

১৯৮১ সালে ‘অ্যা কনফেডারেসি ডানসেসিন’ এর জন্য লেখক জন কেনেডি টুলকে পুলিত্জার পুরস্কার দেওয়া হয়। এর এক দশক আগেই বিষাক্ত কার্বন-মনো অক্সাইড গ্যাস নিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি। জনের মৃত্যুর পর তার মা প্রায় ১০ বছর হন্যে হয়ে ঘুরেছিল, যেন বইটি প্রকাশ পায়।

ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ মায়াকোভস্কি

রুশ বিপ্লবের অন্যতম পথিকৃত মায়াকোভস্কিকে রাশিয়ান কবিতার ‘রেগিং বুল’ বলা হয়। পুঁজিবাদ, অসাম্যতা ইত্যাদি নিয়ে লেখা তার কবিতা বিভিন্ন ভাষায় অনুদৃত হয়। সমাদৃত হন গোটা বিশ্বে। ঘটনাক্রমে তার সঙ্গে পরিচয় হয় অভিনেত্রী ভেরোনিকা পোলানস্কায়ার। প্রথম দেখাতেই তিনি ভেরোনিকার প্রেমে পড়ে যান।

১৯৩০ সালে স্ত্রী ইয়ানশিনের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করেন মায়কোভস্কি। এরপর পোলানস্কায়ারকে বিয়ের কথা বলেন তিনি। কিন্তু রাজী হন না অভিনেত্রী। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন প্রেমিক কবি। ১৯৩০ সালের ১৪ এপ্রিল প্রেমিকার সাথে দেখা করার পর সকাল ১০টা ১৭ মিনিটে রিভলভার দিয়ে আত্মহত্যা করেন মায়কোভস্কি।

জন ব্যারিম্যান

সনেট কাব্য সংকলনের জন্য ১৯৬৪ সালে জন পুলিত্জার পুরস্কার পান জন। ৩৮৫টি কবিতা সম্বলিত বইটি ওই সময়ের অন্যতম সেরা কাব্যগ্রন্থের স্বীকৃতি পায়। গোটা বিশ্বে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে জনের। তবুও বাবার মতই আত্মঘাতী হন তিনি। ১৯৭২ সালে ওয়াশিংটন এভিনিউ ব্রিজ থেকে প্রায় ৯০ ফুট নিচে মিসিসিপি নদীতে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন।

ডেভিড ফস্টার ওয়ালেস

তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখক এবং ইংরেজির প্রভাষক। তার রচিত ‘ইনফিনিটি জাস্ট’ বইটি ইংরেজি ভাষার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ১০০ বইয়ের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।

হঠাৎই তিনি মেরি কার নামে এক কবির প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু মেরির কোনো আগ্রহ ছিল না তার প্রতি। ওয়ালেস মেরির প্রতি এতটাই আসক্ত ছিলেন যে, তিনি নিজের শরীরে ট্যাটু দিয়ে মেরির নামও লিখিয়ে ছিলেন। মেরির ভালোবাসা না পেয়ে তিনি মদসহ বিভিন্ন নেশায় ঝুঁকে পড়েন। দীর্ঘদিন হতাশাগ্রস্ত ওয়ালেস ২০০৮ সালের ১২ মেপ্টেম্বর, ৪৬ বছর বয়সে, দুই পাতার নোট লিখে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

সিলভিয়া প্লাথ

ইনি ছিলেন আমেরিকান কবি ও ঔপন্যাসিক। মাত্র ২০ বছর বয়সে সিলভিয়া আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। সেবার তিনি ব্যর্থ হলেও আত্মহত্যার প্রবণতা রয়ে যায় তার। দ্বিতীয়বার তার উদ্দেশ্য সফল হয়। কবি টেড হিউজের সঙ্গে সম্পর্কছেদ হয়ে যাওয়াতে প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পান সিলভিয়া।

একদিন গ্যাসের সাহায্যে মরার উদ্দেশ্যে, গ্যাস ছেড়ে দিয়ে চুলার সামনে নিজের মাথা নিয়ে যান তিনি এবং চুলে আগুন লেগে পুড়ে মরেন। ১৯৮২ সালে মরণোত্তর পুলিত্জার পুরস্কার পান সিলভিয়া প্লাথ।

এছাড়াও…

  • অন্যতম বিখ্যাত সাহিত্যিক পল ক্লি ৪৯ বছর বয়সে সিন নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
  • প্রখ্যাত সাহিত্যিক হার্ট নৌকা থেকে মেক্সিকান উপসাগরে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। তখন হার্ট ক্রেনের বয়স মাত্র ৩২।
  • কবি গিলিজ ডিলুয়েজকে অসুস্থতার জন্য বাধ্যতামূলক অক্সিজেন মেশিন ব্যবহার করতে হত। একদিন তিনি মেশিনটি জানালার বাইরে ফেলে দিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেন।
  • বিখ্যাত সাহিত্যিক কোয়েসলার আত্মহত্যার আগে দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন।
  • জার্জি কসিনস্কি সুইসাইড নোটে লিখে গিয়েছিলেন, ‘আমি এখন ঘুমোতে যাচ্ছি, আমি এখন একটু বেশি সময় ধরেই ঘুমাব। তোমরা এটাকে অনন্তকালের ঘুম বলতে পার।’
  • সাল ১৯৪১, এপ্রিলের একদিন গাড়ি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান কবি কারিন বোয়ে। কিছুদিন পর তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। জানা যায়, অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন তিনি।

সাহিত্যিকরা দাবী করেন তারা প্রকৃতি নিয়ম ভাঙা পছন্দ করেন না। কিন্তু এমন অনেকেই আছেন যারা নিয়ম ভাঙ্গতেই বেশি পছন্দ করেন। এসব আত্মহত্যাও নিয়মের ভিতরে হয়নি অবশ্যই…

আরো পড়ুনঃ

Leave a Reply