সাগরের নিচের অদ্ভুত শহর

পানির নিচের হারানো শহর, তাও কিনা লক্ষ বছর আগেকার ! এখানেই শেষ নয়, এই গভীর সমুদ্রের নিচে পাওয়া যেতে পারে পিরামিড ! সত্যই এমন ঘটনা হজম করা যেকোনো মানুষের পক্ষে কষ্টকর। সে যতই কল্পবিলাসী হোক না কেনো। ব্যাপারটা একেবারে যেনো আস্ত পিরামিড গিলে নেয়ার মতই অসম্ভব। তাও যদি শক্ত প্রমাণ পাওয়া যেত, তাহলে হয়ত এতদিনে মানব সভ্যতার ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত। কিন্তু যেমন রহস্যময় এই শহরের আবির্ভাব, তেমনই রহস্যময় এই খবরের সত্যতা।

হারানো আটলান্টিসের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে এই বিষয়ে গুজবও কম ছড়ায়নি। ইন্টারনেটে হোক বা পত্রিকার কলামে, লেখনির বুননিতে গল্পের কারেন্ট জাল বিছিয়ে পাঠক শিকার করতে কেউ পিছপা হয়নি তখন। এত জল্পনা কল্পনা ফুরাতেও খুব বেশি সময় নেয়নি। পাঠক শিকারীরা নিজেরাই ঘায়েল হয়ে ফিরেছে এরপর।

সময়টা এখন থেকে প্রায় সতেরো বছর আগে। ২০০১ সালে কিউবার সর্ব পশিচম উপকূলে ‘পিনার ডেল রিও’ প্রদেশে (Pinar del Río) একটি অনুসন্ধানী দল কাজ করছিল। হঠাৎ তাদের সনার (Sonar) যন্ত্রে অদ্ভুত এক চিত্র ধরা পরে। কিছু অসামাঞ্জস্যপূর্ণ গঠনের পাথর তারা দেখতে পান সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০০০ থেকে ২৩০০ ফিট গভীরে। যদিও সনার চিত্রে সূক্ষ্ম করে কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু অনুসন্ধানী দলটি সমুদ্রের যে অংশে কাজ করছিলো, সেখানে উঁচু-নিচু সামুদ্রিক টিলা বা পাহাড় থাকার কোন সম্ভবনা ছিল না। যন্ত্রের হিসাবে সেগুলো পাথরের স্তম্ভ অথবা সেই ধরনের কিছু। আর সেই ছবিতে স্থাপনাগুলো বেশ সুন্দর ভাবে সাজানো বলেই মনে হয়েছিল।

পাউলিন যালিটজ্কি (Pauline Zalitzki) পেশায় একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার এবং তার স্বামী পল ওয়েইঞ্জওয়েইগ (Paul Weinzweig) মিলে একটি কোম্পানি চালান যাদের মূল কাজ সমুদ্রের নিচের বিভিন্ন ধরনের অনুসন্ধান আর জরিপ করা। অ্যাডভান্স ডিজিটাল কমিউনিকেশনস নামের এই কানাডিয়ান কোম্পানিটি কিউবার সরকারের সাথে চুক্তির মাধম্যে ক্যারিবিয় সাগরে কিউবান সমুদ্রসীমায় অনুসন্ধানের কাজ করছিল। তৎকালীন ফিদেল কাস্ত্রোর সরকারের সহযোগিতায় মোট চারটি দল বিভিন্ন স্থানে এই কাজ শুরু করে। অনুসন্ধানের এই মহাযজ্ঞের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, স্পানিশ ঔপনিবেশিক আমলের জাহাজ খোঁজা। কিউবার উপকূলবর্তী এই এলাকার সমুদ্র পথটি বহু আগে থেকেই জাহাজ চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ পথ হিসেবে পরিচিত ছিল। ক্যারিবিয় সাগরের এই এলাকায় বহু মূল্যবান সামগ্রী ভরা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে। অত্যাধুনিক আর জটিল সব যন্ত্রপাতির সাহায্যে এই হারানো জাহাজ খোঁজার অভিযান চালাতে যেয়েই যাল্টিস্কি আর তার দল হঠাৎ খুঁজে পায় অদ্ভুত এই পাথরের স্থাপনাগুলো।

প্রাথমিক চিত্রগুলো দেখার পর এই বিষয়ে আরও নিশ্চিত হতে, সেই বছরেরই জুলাই মাসে তারা আবারও ফিরে আসেন পিনার ডেল রিও প্রদেশে। এবারের অভিযানে সঙ্গী হন স্থানীয় জাতীয় যাদুঘরের অভিজ্ঞ ভূতত্ত্ববীদ মানুয়েল ইটরাল্ড (Manuel Iturralde)। অনুসন্ধানের জন্য যুক্ত হয় আরও আধুনিক সুক্ষ যন্ত্রপাতি। সনাররের মাধম্যে ছাড়াও দূর থেকে নিয়ন্ত্রন করা যজায়েমন গভীর পানির নিচে ছবি তুলতে ও ভিডিও করতে সক্ষম মানববিহীন জাহাজ ব্যাবহার করা হয় অভিযানে। এবারের ছবি গুলো হয় আরও স্পষ্ট এবং আগের চাইতে আরও বিস্ময়কর। ছবিতে ফুটে ওঠে মসৃণ পাথরের খণ্ড। যেগুলো দেখে মনে হয় গ্রানাইট পাথরের ভেঙ্গে পরা অংশ হয়তো। এই এক একটা পাথরের খণ্ডের মত অংশ আনুমানিক ৮ ফিট বাই ১০ ফিট আকারের। আজকের দিনের মধ্যবিত্ত পরিবারের ভাড়া করা বাসার একটি রুমের সমান প্রায়। কোন কোন পাথরের খণ্ড একা দাঁড়িয়ে আছে আবার কিছু খণ্ড দেখে মনে হয় একটির উপর আর একটি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আর যাই হোক এগুলোকে প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়াল বলে মনে হয়নি ছবিতে। সমুদ্রের অনেক বেশি গভীরে হওয়ায় এবং তৎকালীন প্রযুক্তি এখনকার তুলনায় কম ক্ষমতা সম্পন্ন হওয়ায় এই সবই অনেকটা নিজেদের পূর্ব অভিজ্ঞতা আর যুক্তির ভিত্তিতে চিন্তা করছিল অনুসন্ধানী দলটি। এছাড়া পরবর্তীতে তারা এও জানান যে, প্রতিকূল আবহাওয়া আর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে তারা অনুসন্ধান খুব বেশি আগাতে পারেন নি। তবু যে ছবি তারা সংগ্রহ করেন তাতে আরও অদ্ভুত সব আকৃতি ফুটে উঠতে থাকে। কিছু পাথর খণ্ডের উপরে চুড়ার মত আছে বলে মনে হয়। ঠিক যেন পানির নিচে ঘুমিয়ে আছে মস্ত কোন পিরামিড। গোলাকার কিছু স্থাপনাও এর সাথে চোখে পরে। প্রায় দুই বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এসব রহস্যময় আকৃতি দেখে দলটির মনে হতে থাকে, হয়ত এটি বহু আগে সমুদ্রে বিলিন হয়ে যাওয়া প্রাচীন কোন নগরীর ধ্বংসাবশেষ। রহস্যময় এই স্থাপনা ‘কিউবার পানির নিচের শহর’ নামে পরিচিত।

রহস্যময় এই নগরীর খবর ছড়িয়ে পরা মাত্র সবাই একে তুলনা করতে শুরু করে হারানো আটলান্টিসের সাথে। অবস্থা যেমন দাঁড়িয়েছে তাতে পানির নিচে প্রাচীন কিছু পাওয়া গেলেই সেটি আটলান্টিস বলে ধরে নেয় অনেকে।আনলান্টিস হলো গ্রীক পুরানের সেই শহর যার ওপর সমুদ্রের দেবতা পসেইডনের অভিশাপ পড়েছিল।কিংবদন্তি আছে যে,আটলান্টিস শহর বর্তমান পৃথিবী থেকে কয়েকশগুণ উন্নত ছিলো। তারা টাইম ট্রাভেল ও করতে পারতো।

আর এই শহরের রাজা ছিলেন পসেইডন এর প্রিয়পুত্র আটলান্টা/আটলান্টিস। পসেইডন এর আশীবার্দ এ মূলত শহরটা এত উন্নত হয়েছিলো। কিন্তু,বেশি উন্নত হওয়ার দরূণ তারা নিজেদের সেরা ভাবতে শুরু করে। ফলস্বরূপ পসেইডন পুরো আটলান্টিক মহাসাগরকে তাদের উপর ঢেলে দেন। তারা অতলে নিমজ্জিত হয়। কিন্তু অনেক ইতিহাসবিদ এই অদ্ভুত শহরকে আটলান্টিস হিসেবে ভাবতে পারেননি।

যাল্টিস্কির মতে, যদি তাদের আবিষ্কার সত্যিই কোন প্রাচীন জনপদের অংশ হয়ে থাকে তাহলে সেটি স্থানীয় কোন প্রাচীন নগরী হবার সম্ভবনা আছে। ইতিহাসের আভাস অনুযায়ী কোন এক সময় কিউবা এবং মেক্সিকোর মাঝে সংযোগকারী ভূভাগ ছিল। সেই অংশের কোন নগরী হয়ত পরবর্তীতে সমুদ্রে বিলিন হয়ে যায়। স্থানীয় যাদুঘরের ভূতত্ত্ববীদ ইটরাল্ড এর সাথে আরও যোগ করেন, স্থানীয় মায়া এবং ইউক্যটেকস (Yucatecos) গোত্রের প্রচলিত লোকগাথা অনুযায়ী তাদের পূর্বপুরুষরা এমন এক দ্বীপে বাস করত যা সমদ্রের ঢেউয়ের মাঝে হারিয়ে গেছে। কিন্তু তার পরও তিনি এই রহস্যময় স্থাপনা বা বলা চলে আকৃতি গুলোকে প্রাকৃতিক ঘটনা হবার সম্ভবনা একেবারে উড়িয়ে দেননি তিনি।

সাগরের নিচের এই রহস্যময় আবিষ্কার যদি সতি বলে প্রমানিত হয়, সে ক্ষেত্রে অনেক ইতিহাস বদলে যাবার সম্ভবনা থেকে যায়। ক্যারিবিয় সাগরের যে স্থানে এই স্থাপনা গুলো খুঁজে পাওয়া গেছে সেটি বহু প্রাচীনকাল থেকেই সমুদ্রপথ হিসেবে ব্যাবহার হয়ে আসছে এবং ইতিহাসে এরকম কোন বন্দর বা নগরের উল্লেখ পাওয়া যায়নি যার সাথে এই স্থাপনাগুলোর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যদি ধরে নেই প্রাচীনকালে এই অঞ্চল শুষ্ক স্থলভূমি ছিল, সেই ক্ষেত্রে প্রশ্ন চলে আসে তাহলে কি ক্যারিবিয় সাগর অন্যকোন জলাশয় থেকে পরবর্তীতে সৃষ্টি হয়েছে? এ ছাড়াও প্রশ্ন থাকে স্থাপনা তৈরির কৌশল নিয়েও। এতো প্রশ্নের কোনটির সঠিক উত্তর আজও জানা যায় নি। মূলত কিউবা সরকার এর পৃষ্ঠপোষকতায় এই অনুসন্ধান প্রাথমিক ভাবে চালানো হলেও, নতুন ভাবে কোন কাজ অথবা গভীর সমুদের মানুষের মাধ্যমে অনুসন্ধানের কোন খবর গত ষোল বছরেও জানা যায় নি। রহস্য নিয়ে যেমন শুরু হয়েছিল এই আবিষ্কার তেমনি রহস্যময় ভাবেই থেমে যায় এর অনুসন্ধান।

নোনা পানির সমুদ্র হাজারো রহস্য বুকে নিয়ে বয়ে চলেছে হাজারো বছর ধরে। আরও একটা রহস্য নাহয় জমা থাকলো সেই ঝুলিতে। যুক্তি যতই অসম্ভবই বলুক, আমার মত হয়ত অনেকেই তবু আশা রাখেন একদিন সত্যিই মানুষ আবিষ্কার করবে হাজার বছরের ঘুমিয়ে থাকা এই নগরীকে। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত কল্পনাই থেকে যাবে কিউবার সমুদের নিচের এই শহর।

Leave a Reply