আমি পাগল নই, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত !

ধরুন আপনি কোথাও যাচ্ছেন, হাঁটছেন। আপনার বারবার মনে হচ্ছে পেছন থেকে কেউ যেনো ডাকছে। সেই ভাবনায় পেছন ফিরলেন, ঘুরাঘুরি করলেন, অথচ কিছুই পেলেন না। অথবা আপনি ঘুমোচ্ছেন। ঘুমের মাঝেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে এটা দেখছেন কেউ আপনাকে গলা টিপে বা ধাঁরালো ছুরি দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। তড়িঘড়ি করে উঠেও কিছুই পেলেন না। একগাদা দুঃশ্চিন্তা নিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন।

কি এসব? অলৌকিক লাগে না? ভৌতিক কিছু? নাকি হ্যালোসিনেশন? আর হ্যালোসিনেশনটাই বা কি? এসবের শেষই বা কতদূর? হ্যাঁ, এসব হ্যালোসিনেশন বা উদ্ভট সব চিন্তার পরিসমাপ্তিতেই সিজোফ্রেনিয়ার সৃষ্টি।

সিজোফ্রেনিয়া কি?

সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia) হচ্ছে এক ধরণের জটিল মানসিক রোগ। যার উৎপত্তি দুটো গ্রিক শব্দ হতে। একটি Skhizein (to split বা বিভক্ত করা), অন্যটি Phrenos (mind বা মন)। দুটো একত্র করলে দাঁড়ায় ‘স্লিপট মাইন্ড’। অর্থাৎ মনটা ভেঙে গেছে, এমনটা বুঝায়। মনোবিজ্ঞানে এটি বেশ বড় রকমের সাইক্রিয়াটিক ডিজঅর্ডার হিসেবে বিবেচ্য হয়। তরুণ সমাজ বিশেষত (১৫-২৫) বছর বয়সীরা এর প্রধান শিকার। এর দরুণ চিন্তাশক্তির স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়, মস্তিষ্কের কাজের বিঘ্ন ঘটে। অনেকটা সুস্থ মানুষের মাঝেও দীর্ঘস্থায়ী মানসিক বৈকল্য চলে আসে।

সিজোফ্রেনিয়া হব‍ার কারণ

সিজোফ্রেনিয়ার সুনির্দিষ্ট কারণ আজও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। যেহেতু এটি পুরোপুরিভাবেই মনস্তাত্ত্বিক বিষয়, তাই অনেক বিজ্ঞানীরা একে মস্তিষ্কের অক্ষমতার ফসল হিসেবেই বিবেচ্য করেন। মস্তিষ্কের ত্রুটি, একধরনের নিউরোকেমিক্যালের ভারসাম্যহীনতায় এ রোগ হয়। অনেক বিজ্ঞানী আবার এর সাথে বংশগতীয় সম্পর্কের তুলনা করেছেন। মা, বাবা দুজনের মাঝে কোনো একজনের সিজোফ্রেনিয়া থাকলে সন্তানের সিজোফ্রেনিয়া হবার সম্ভাবনা ১৭ শতাংশ। আবার দুজনেরই থাকলে সম্ভাবনা দাঁড়ায় ৪৬ শতাংশ।

সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক সিজোফ্রেনিয়ার রহস্য উদঘাটনে ভালো সফলতা পেয়েছেন। তাদের ভাষ্যমতে – “সিজোফ্রেনিয়াকে স্বাভাবিকভাবে রোগ সম্বোধন করা হলেও এটি কোনো রোগ নয়। মোট আট প্রকারের ভারসাম্যহীনতার সমন্বিত রূপ হচ্ছে সিজোফ্রেনিয়া। অনেকের ক্ষেত্রে জীনগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনা। ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে মস্তিষ্কে বিঘ্ন ঘটায়। ফলে সিজোফ্রেনিয়া হয়।”

সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ

কোনো রোগেরই ধরাবাধা নিয়ম নেই। সিজোফ্রেনিয়াও তার ব্যতিক্রম নয়। তবুও সিজোফ্রেনিয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেগুলোর প্রকটতাই রোগীর অবস্থা প্রকাশ করে।

  1. নিজের মাঝে ‘মহাপুরুষ’ সুলভ আচরণ ধারণা চলে আসে। নিজের সিদ্ধান্তকেই প্রাধান্য দেন।
  2. অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবণ হয়। ভাবে অন্যরা (বাবা,মা, ভাইবোন, অন্যান্য আত্মীয়, কোনো ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান সহ যে কেউ) তাকে হত্যা করার চেষ্টা করছে বা কোনো না কোনোভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা করছে।
  3. অনেক অবাস্তব জিনিস কল্পনা করেন নিজের মাঝেই, যেগুলো তার মাঝে বাস্তবের অনুভূতি তৈরী করে।
  4. অসংলগ্ন আচরণ করেন, কথাবার্তায় সাবলীলতা থাকে না।
  5. হঠাৎ হঠাৎই কানে বিভিন্ন আওয়াজ শুনতে পান, নিজে নিজে কথা বলেন।
  6. খুব বেশী আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। বাচ্চাদের মত আচরণ করেন, প্রায় সময়ই সামান্য কারণে কান্নাকাটি করেন।
  7. হঠাৎ করেই কাউকে মারতে উদ্যত হয়ে যান।
  8. বাথরুমে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকেন।
  9. কোনো কাজে উৎসাহ পান না।
  10. বিপরীত লিঙ্গ সহ সবার প্রতিই অনাসক্তি বোধ করেন। একা থাকতে পছন্দ করেন।

আর এসব লক্ষ্মণ যে হঠাৎই হবে এমন কিন্তু নয়। সিজোফ্রেনিয়া একটি দীর্ঘক্ষণিক প্রক্রিয়ার ফল। মানসিক বৈকল্যের দীর্ঘসূত্রতার পথ ধরেই আসে সিজোফ্রেনিয়া।

সিজোফ্রেনিয়ার বর্তমান

পৃথিবী উন্নত হচ্ছে, প্রযুক্তিনির্ভর হচ্ছে, সাথে সামাজিক সম্পর্কের টানাপোড়ন বাড়ছে। সহযোগিতার পরিবর্তে “আমি আমার, কেউ কারো নয়” মনোভাব বাড়ছে। মনের সংকীর্ণতা বাড়ছে, প্রতিহিংসা বাড়ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মনুষ্যত্ব। বাড়ছে একাকীত্ব, বাড়ছে ‘ডিপ্রেশন’ ব্যাধি। ফলস্বরূপ বাড়ছে সিজোফ্রেনিয়া। সারা বিশ্বে সিজোফ্রেনিয়া রোগীর সংখ্যা বর্তমানে (০.৩-০.৭) %। চীন, ভারতেও এর প্রকোপ নেহায়েত কম নয়। চীনে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৬০ লাখ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ, আর ভারতে ৪০ লাখ ৩০ হাজার থেকে ৮০ লাখ ৭০ হাজার। তেমনিভাবে বাংলাদেশও সিজোফ্রেনিয়ার করাল গ্রাসে আটকে গেছে। বাংলাদেশে এমন রোগীর সংখ্যা ১৬ লাখ, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ০.০৬%। এটি নিঃসন্দেহে ভাবনার বিষয়। এ রোগে আক্রান্তদের আমাদের সমাজে ভালো চোখে দেখা হয়না। সোজা পাগল বলে চালিয়ে দেয়া হয়। অনেককে আবার ঝাড় ফুক, তেলপড়া, পানি পড়া, শিকলে বেধে নির্যাতন এসবের স্বীকার হতে হয় প্রতিনিয়তই। এসবের পর শতকরা ১০ ভাগ সিজোফ্রেনিয়ার রোগীই আত্মহত্যা করে। যা আমাদের স্বৈরাচারী মনোভাব আর অসচেতনতাকেই প্রমাণ করে। কিন্তু শত ভাবনার মাঝেও আমাদের সবার আগে এটাই মাথায় রাখতে হবে ‘প্রতিকারেই মুক্তি, নিপীড়নে নয়!’

সিজোফ্রেনিয়া প্রতিকার

‘সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত মানেই পাগল’ – এমন ভাবার অবকাশ নেই। আমাদের আশেপাশে প্রচুর সিজোফ্রেনিক আছে। অতএব বৈকল্য যেহেতু আছে, এর প্রতিকারও আছে। সিজোফ্রেনিয়া প্রতিকারে আহামরি কোনো দায়িত্ব সম্পাদন করতে হয়না।

প্রাথমিক দিকেই যখন পরিবর্তন আসতে শুরু করে তখনই তার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। সিজোফ্রেনিক রোগীকে সময় দিতে হবে, একাকীত্ব দূরীকরণ ব্রত হতে হবে, তার ইচ্ছাগুলোকে গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। ভালো সাইক্রিয়াটিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে। শতকরা ২৫ ভাগ রোগীই চিকিৎসা নেবার পর একদম সুস্থ হয়ে যায়। ৫০ ভাগ বিভিন্ন ঔষধ সেবনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। বাকি ২৫ ভাগ কখনোই সুস্থ হয়না। কাজেই রোগীটির ব্যাপারে প্রথমাবস্থাতেই সর্তক হতে হবে। সেজন্যই তো কথায় বলে ‘সময় গেলে সাধন হবে না’।

মোটকথা, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা পাগল নয়। রোগটার জন্য তারাও দায়ী নয়। দায়ী যদি কাউকে করতেই হয় তবে সেটা হবেন আপনি, আমি আমরা সবাই। আমাদের হেয় করার মনোভাবের জন্যই তারা দূরে সরে যাচ্ছে, গুটিয়ে নিচ্ছে সব থেকে। হয়তো অনেক প্রিয়জনকে পর্যাপ্ত সময় না দেবার দরুণ তাদের মনেও ক্ষোভ জমেছে। অজানা একাকীত্বের বিষেই নিজেই পুড়ছে। অথচ কাছের মানুষ হয়েও আমরা দূরে। তাই আসুন, ‘নিবেদিত হই, ভালোবাসার মায়ায় আকড়ে ধরি সেই মানুষগুলোকে, বাঁচিয়ে দেই সেই অসুস্থ কয়টা প্রাণকে!’

Leave a Reply