বাংলাদেশি সায়েন্স ফিকশন সিনেমা !

সায়েন্স ফিকশন; সংক্ষেপে সাই-ফাই, বাংলায় বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। সাহিত্য ও সিনেমা জগতের একটি অতিপরিচিত ও জনপ্রিয় ধরণ। সাধারণ লোকজন মনে করেন খাঁটি বৈজ্ঞানিক সত্যতাকে কেন্দ্র করে সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস বা সিনেমা নির্মিত হয়। এটা একেবারেই ভুল ধারণা। খাঁটি বিজ্ঞানকে নয়, বরং প্রচলিত বিজ্ঞানে এখনো পুরোপুরি সত্য প্রমাণিত হয়নি, অথচ কল্পনা করা হচ্ছে একদিন তা সত্য প্রমাণিত হবে; বিজ্ঞানকে ভিত্তি করে এমন সব বিষয়বস্তু নিয়ে রচিত সিনেমাই হচ্ছে সায়েন্স ফিকশন।

বিশ্বের প্রথম সায়েন্স ফিকশন মুভি হচ্ছে Le Voyage dans la Lune (A Trip to the Moon) ! জর্জেস মিলিস পরিচালিত ১৯০২ সালের এই ফরাসী মুভিটি এতই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, মুভিটি সেই আমলেই পাইরেসিতে রেকর্ড সৃষ্টি করে। তখন থেকে চোখের সামনে বিজ্ঞানের লীলাখেলা দেখার জন্য মানুষের যে উন্মাদনা শুরু হয়, তা আজও বহাল তবিয়তে টিকে আছে।

“বাংলাদেশের সিনেমায় সায়েন্স ফিকশন” – এটুকু শুনলেই অনেক অত্যাধুনিক নাগরিক হেসে খুন হয়ে যাবে। এটা স্বীকার করি, যে দেশের প্রায় প্রতিটা অ্যাকশন দৃশ্যে পদার্থ বিজ্ঞানকে বলাৎকার করা হয়, সে দেশে সায়েন্স ফিকশন মুভি আশা করা আর অরন্যে রোদন একই কথা। যে দেশের গোটা সিনেমার টাকা দিয়েও উন্নত দেশের সিনেমার একটি সিকোয়েন্স করা কষ্টকর, সে দেশ বানাবে সায়েন্স ফিকশন মুভি !

আমি আগেও বলেছি বাংলাদেশের সিনেমা নির্মাতারা অল্প বাজেটে ‘বড় বড়’ সিনেমা নির্মাণের অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মান। পাহাড় সমান সীমাবদ্ধতা নিয়েও মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর আগেই আমরা কয়েকটি সায়েন্স ফিকশন মুভি নির্মাণ করে দেখিয়েছি। আজ সেগুলো নিয়েই আলোচনা করবো। তার আগে বলে রাখি, যারা সায়েন্স ফিকশন মুভি বলতে শুধু এলিয়েন আর টাইম মেশিন বোঝেন, তাদের জন্য দেড় মিনিট নিরবতা। চলুন শুরু করা যাক…

বাংলাদেশি সায়েন্স ফিকশন সিনেমা

১. সুপারম্যান (১৯৯৭) : ডিসি কমিকসের সুপারম্যান সম্পর্কে জানেন না, এমন বান্দা মনে হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। পিতার ইচ্ছায় ভীনগ্রহ থেকে পৃথিবীতে আসা অতিমানবীয় ক্ষমতা সম্পন্ন এক মানুষের গল্প নিয়ে হলিউডের মত বাংলাদেশে ১৯৯৭ সালে “সুপারম্যান” নির্মাণ করেন ইফতেখার জাহান। ছবিটির নাম ভূমিকায় ড্যানি সিডাক , তার বিপরীতে ওয়ান্ডার ওম্যান চরিত্রে নূতন এবং প্রধান খল চরিত্রে ছিলেন নাসির খান। বাংলাদেশের প্রথম এই সায়েন্স ফিকশন মুভিটি মোটামুটি ভাল সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য তৎকালীন ভারতীয় সুপারম্যান সিনেমার চেয়ে আমাদের সুপারম্যানের মান বেশ ভাল ছিল। দুটোই ইউটিউবে আছে, বিশ্বাস না হলে দেখে নিতে পারেন।

২. শক্তির লড়াই (১৯৯৮) : পরিবার নিয়ে বেড়াতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের আক্রমণে মারাত্মকভাবে আহত হন একজন সৎ পুলিশ অফিসার। এদিকে রোবোটিক সায়েন্স নিয়ে গবেষণা করা এক বিজ্ঞানী তার গবেষণার প্রয়োগ করেন সেই মুমূর্ষু পুলিশ অফিসারের উপর। অতঃপর সেই পুলিশ অফিসার হয়ে উঠেন রোবোটিক ক্ষমতাসম্পন্ন। এমনই গল্প নিয়ে ইফতেখার জাহান ১৯৯৮ সালে নির্মাণ করেন “শক্তির লড়াই”। ছবিটি তৎকালীন সময়ে বিটিভিতে প্রচারিত বাংলায় ডাবিং করা জনপ্রিয় কানাডিয়ান সিরিজ RoboCop এর আদলে নির্মিত। যেখানে মূল চরিত্রে ড্যানি সিডাক ছাড়াও নূতন, শাহিন আলম, গোলাম মুস্তফা, নাগমা প্রমুখ অভিনয় করেন। ছবিটি দর্শকমনে ভাল সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, “শক্তির লড়াই” বা রোবকপ হচ্ছে সাইবারপাঙ্ক গোত্রের সিনেমা। যা এক ধরনের সায়েন্স ফিকশন।

৩. কালো চশমা (১৯৯৮) : সৎ ও পরিশ্রমী হুমায়ুন ফরীদি সন্ধান পেয়ে যান সুপার রেডিয়েশন পাওয়ার সম্পন্ন একটি কালো চশমার; যা মুহূর্তের মধ্যে যেকোন জিনিসকে মডিফাইড করে ফেলতে পারে। শুরু হয় সেই চশমার অপব্যবহার। এমনই গল্প নিয়ে এনায়েত করিম ১৯৯৮ সালে নির্মাণ করেন “কালো চশমা”। ফরীদি সাহেব ছাড়াও ছবিটিতে অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন রুবেল একা, মেহেদি, মৌ প্রমুখ। ছবিটি মোটামুটি সফলতা অর্জন করে।

৪. পারলে ঠেকাও (১৯৯৯) : মান্না আদর্শবান পুলিশ অফিসার। অপরাধ জগতের পথে বাধা হওয়ায় তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার চেষ্টা করা হলেও সে বেঁচে যায়। তবে তার নতুনভাবে সক্রিয় হবার উপায় থাকে না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিশেষ একটি ব্যবস্থায় মানবদেহে রূপান্তরিত যান্ত্রিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মান্নাকে নতুন জীবন দেয়া হয়। বিশেষ পোশাক পরে মান্নার উর্ধ্বতন পুলিশ তার সাথে কথা বলে অপরাধ জগত ধ্বংসের নির্দেশ দেয়। বিশেষ পোশাকটি পরা থাকলে তার নির্দেশ মানতে বাধ্য মান্না। এরপর তার দ্বিতীয় মিশন শুরু হয়। তবে মান্না মানুষের মধ্যে মিশে অপরাধ জগতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এমনই গল্প বাবুল রেজা ১৯৯৯ সালে নির্মাণ করেন “পারলে ঠেকাও”। মান্না ছাড়াও ছবিটির অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন কবিতা, বাপ্পারাজ, অন্তরা, গাঙ্গুয়া প্রমুখ। ভিন্নস্বাদের এই একশন মুভিটি দর্শকদের ব্যাপক বিনোদিত করতে সক্ষম হয়।

৫. রঙ্গীন চশমা (২০০৪) : এক বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে এক রঙিন চশমা আবিষ্কার করেন। যেটা চোখে দিয়ে দুপাশে চাপ দিলে কাক্ষিত সবকিছু দেখা যায়, পাশাপাশি চশমার রশ্মিতে অন্যকে হতাহত করা যায়। বিজ্ঞানী তাদের এরকম চশমা দিতে চান যারা দেশের ও জনগণের জন্য কাজ করবে। কিন্তু এক অর্থলোভী শিষ্য বিজ্ঞানীকে হত্যা করে চশমাটা ছিনতাই করে। বিজ্ঞানী মৃত্যুর মুহূর্তে আরেকটি চশমা ও অসমাপ্ত গবেষণাকর্ম তুলে দেন একজন সাহসী লোকের হাতে। এমনই গল্প নিয়ে পরিচালক এ আর রহমান ২০০৪ সালে নির্মাণ করেন “রঙ্গীন চশমা”। ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম, আলেকজান্ডার বো, পলি, শানু, মিশা সওদাগর প্রমুখ অভিনীত ছবিটি মোটামুটি ব্যবসাসফল হলেও অশ্লীলতার দায়ে দুষ্ট হয়।

৬. টাকা (২০০৫) : “মানুষের জীবনে টাকা-ই সবকিছু না”। মূলত এই থিম নিয়ে “টাকা” ছবিটি নির্মিত। এটুকু শুনেই ছবিটি না দেখা কেউ কেউ এটিকে সোশ্যাল ড্রামা মুভি বলে আখ্যায়িত করতে পারেন। কিন্তু এই ছবিটির গল্প আবর্তিত হয়েছে মহাকাশ থেকে খসে পড়া একটি উল্কার ভেতরে পাওয়া দুটি কয়েনকে ঘিরে। কয়েন দুটো পাশাপাশি দুজন মানুষ বা প্রাণীর কাছে থাকলে তাদের নিজেদের সত্তা পরস্পরের সাথে বিনিময় হয়ে যায়। সহজ ভাষায় একটা কয়েন X এর কাছে এবং একটা কয়েন Y এর কাছে থাকলে; তারা পরস্পর পাশাপাশি আসলে কয়েন দুটোর পারস্পরিক আকর্ষণ-বিকর্ষনের ফলে X Yতে এবং Y X এ পরিণত হয়ে যায়। শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত ২০০৫ এর এই সিনেমাটিতে বিভিন্ন চরিত্রে রিয়াজ, পূর্ণিমা, আলমগির, সোহেল রানা, হুমায়ুন ফরীদি প্রমুখ অভিনয় করেন। একটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন ছাড়াও ছবিটি মোটামুটি ব্যবসাসফল হয়।

৭. মেশিনম্যান (২০০৭) : “শক্তির লড়াই” সিনেমার মত এই সিনেমাতেও একজন আহত পুলিশ অফিসারের শরীরের রোবোটিক সায়েন্স প্রয়োগ করে তাকে “মেশিনম্যান” এ পরিণত করা হয়। প্রায় একই রকম সুপারপাওয়ার সম্পন্ন খলনায়ক বায়োনিকম্যানের সাথে মেশিনম্যানের সংঘাতের গল্প নিয়ে যুগল পরিচালক সাফি ইকবাল ২০০৭ সালে নির্মাণ করেন “মেশিনম্যান”। নাম ভূমিকায় মান্না ছাড়াও মৌসুমি, অপু বিশ্বাস, কাজী হায়াৎ, ড্যানি সিডাক প্রমুখ ছবিটিতে অভিনয় করেন। ছবিটি ব্যবসাসফল হতে সক্ষম হয়।

৮. টাইম মেশিন (২০১৪) : স্কুলের ছুটিতে কক্সবাজার বেড়াতে এসে জঙ্গলে এক আহত এলিয়েনকে দেখতে পায় কয়েকটি শিশু ও তাদের গাইডেরা। সেই এলিয়েন শিশুদের তার টাইম মেশিনটি উপহার দেন। এ টাইম মেশিনের বদৌলতে শিশুরা চলে যায় হারকিউলিস, ডাইনোসর ও টারজানের রাজত্বে। এমনই গল্প নিয়ে সায়মন জাহান ২০১৪ সালে নির্মাণ করেন শিশুতোষ সাই-ফাই মুভি “টাইম মেশিন”। ছবিটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন রত্না, আইরিন সুলতানা, ড্যানি সিডাক প্রমুখ। মুক্তির আগে সিনেমাটি নিয়ে দর্শকদের ব্যাপক কৌতূহল থাকলেও; সিনেমাটির মানহীন গল্প ও ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণের কারনে কল্পনাতীত নেতিবাচক মন্তব্যের সম্মুখীন হয়।

৯. দ্যা স্টোরি অফ সামারা (২০১৫) : নিজের গ্রহকে অপশক্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য পৃথিবীর পাঁচ যুবক-যুবতীর সাহায্য নিতে টাইম ট্রাভেল করে পৃথিবীতে আসেন জেমস ট্রিনিটি। অতঃপর ঘটতে থাকে একেরপর এক অতিপ্রাকৃত ঘটনা। এমনই গল্প নিয়ে রিকিয়া মাসুদো ২০১৫তে নির্মাণ করেন একাধারে সাই-ফাই হরর এডভেঞ্চার মুভি “দ্যা স্টোরি অফ সামারা”। মুক্তির আগে ছবিটি বেশ আশার সঞ্চার করলেও শেষপর্যন্ত ছবিটি ব্যর্থ হয়।

১০. পরবাসিনী (২০১৭) : পৃথিবীতে নেমে আসা এক ভিনগ্রহবাসী নারীর গল্প নিয়ে স্বপন আহমেদ ২০১৭ সালে নির্মাণ করেন বিগ ক্যানভাসের বহুল আলোচিত ও প্রতীক্ষিত সিনেমা “পরবাসিনী”। নাম ভূমিকায় ভারতের রিথ মজুমদার ছাড়াও ছবিটির অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেন ইমন, সব্যসাচী চক্রবর্তী, সোহেল খান প্রমুখ। খাপছাড়া গল্প ও দুর্বল নির্মাণশৈলীর কারনে ছবিটি বক্স অফিস ও দর্শক হৃদয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে।

১১. বিজলী (২০১৮) : বজ্রপাতে নিহত এক গর্ভবতী মায়ের গর্ভে জন্ম নেয় বিদ্যুতের অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাসম্পন্ন বিজলী নামের এক কন্যাসন্তান। নিজের রিসার্চে অশুভ শক্তি হাসিলের জন্য ডাক্তার জেরিনের প্রয়োজন বিজলীকে। শুরু হয় শুভ আর অশুভ শক্তির লড়াই। এমনই গল্প নিয়ে ইফতেখার চৌধুরী ২০১৮ তে নির্মাণ করেন “বিজলী”। সিনেমাটির নাম ভূমিকায় ইয়ামিন হক ববি ছাড়াও অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন রণবীর, ইলিয়াস কাঞ্চন, শতাব্দী রায়, মিশা সওদাগর প্রমুখ। ছবিটি ব্যবসায়িক সফলতা অর্জনে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য যে, অনেকে এটাকে বাংলাদেশের প্রথম সুপারহিরো মুভি বলে আখ্যায়িত করছেন। এটা ভুল। আমাদের প্রথম সুপারহিরো হচ্ছেন সুপারম্যান (ড্যানি সিডাক) এবং সুপারহিরোইন ওয়ান্ডার ওম্যান (নূতন)। তবে বিজলী নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের প্রথম মৌলিক নিজস্ব সুপারহিরো মুভি।

একজন বাংলাদেশী সিনেমাপ্রেমী হিসেবেও আমি স্বীকার করছি, আমাদের দেশে নির্মিত সায়েন্স ফিকশন মুভিগুলো ছিল মূলত দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর মত। কারন ভাল মানের সায়েন্স ফিকশন মুভির জন্য প্রয়োজন ভাল প্রযুক্তি; আর ভাল প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজন ভাল বাজেট। যা আমাদের দেশে আপাতত কম। তবে আশা করি খুব শীঘ্রই আমরা সিনেমাতে ভাল প্রযুক্তির ব্যবহার করা শিখব। আমাদের দেশের নায়করাও যাবে মঙ্গল গ্রহে, এলিয়েনদের স্পেসশিপ উড়বে ঢাকার আকাশে। জয় হবে বাংলাদেশের সিনেমার।