দ্য লাঞ্চবক্স : সিনেমাটা আমাদের, আর আমরাই এ সিনেমার গল্প

“আমি সবসময়ই ভাবতাম মানুষটা যখন চলে যাবে তখন আমি কি করবো? কিন্তু এখন? এখন আমার শুধু ক্ষুধা পাচ্ছে!”

কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে, ভাই আপনার পছন্দের তিনটা বলিউড মুভির নাম বলেন, এক দুইয়ে কি বলবো ভাবনার বিষয়। কিন্তু তিন নম্বরে অবশ্যই দ্য লাঞ্চবক্স থাকবে ! পরের প্রশ্নটাই আসবে, ভাই একটা মুভিতে গান নেই মারামারি নেই থ্রিল নেই, এমন কি প্রেম করে একজন আরেকজনের হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এরকম কোন কাহিনীও নেই, একটা এইটিন প্লাস দৃশ্য নেই, তাহলে এত ভালো লাগলো কেনো?

গল্পটা হতে পারত ইরফান খানের, অথবা নিম্রিতা কউর এর, অথবা নওয়াজুদ্দিন সিদ্দীকির, অথবা সেই আন্টির, যিনি এই মুভির খুবই শক্ত চরিত্র হয়েও একটা দৃশ্যতেও তাকে দেখ‍া যায়নি। কিন্তু দিনশেষে আমার কাছে গল্পটা হয়ে গেছে জীবন ঘনিষ্ঠ অথচ তিক্ত বাস্তব কিছু ডায়ালগের।

সাজান ফার্নান্দেজ, বয়স্ক একজন অফিস কর্মচারী, যিনি কিছুদিনের ভেতর অবসর নিবেন। তার স্ত্রী মারা যাওয়ায় তাকে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনিয়ে খেতে হয়। ইলা, এক স্কুলে পড়া বাচ্চার মা, যার জীবনটা বাচ্চা, ঘর সংসার আর রান্নাবান্নাতেই কেটে যায়। ইলা তার স্বামীর জন্য দুপুরের খাবার পাঠায়, সেটা ডেলিভারিম্যানের ভুলের কারণে সাজান ফার্নান্দেজের কাছে চলে যায়। এভাবেই শুরু হয় সিনেমার গল্প। গল্পের বেশ বড় একটা অংশ যাবে চিঠি পড়তে পড়তে। সাথে দেখ‍া যাবে কঠিন হৃদয়ের অফিস কলিগ থেকে সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে যাওয়া। গল্প নিয়ে বলতে গেলে বলেই যেতে হবে…

চিত্রনাট্যের পর দ্য লাঞ্চবক্স ভালো লাগার অন্যতম কারণ, পর্দায় পছন্দের দুই অভিনেতা ইরফান খান ও নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীর একসাথে রসায়ন। তবে সিনেমাটি সবচেয়ে বেশী ভালো লাগবে ডায়ালগের জন্য। জীবন সম্পর্কিত এমন কিছু উক্তি এই সিনেমায় উঠে এসেছে, যা কমবেশ আমাদের সকলেরই বাস্তব জীবনের সাথে রিলেটেড…

যেমন, এক দৃশ্যে ইলা চিঠিতে সাজানকে লিখেছে, “আমার মেয়ে শিখেছে ভুটানে গ্রস ন্যাশনাল প্রোডাক্ট হিসাব করা হয় না, গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস হিসাব করা হয়। আমাদের এখানে কেনো হয় না?”

আরেক দৃশ্যে সাজান ইলা কে বলে “Nobody buys a lottery ticket expired” !

প্রথমে মনে হবে কত সাধারণ ডায়ালগ, কিন্তু এই উক্তিগুলোই আপনার ভালো লেগে যাবে, যখন নিজের পেছনের জীবনের দিকে তাকাতে থাকবেন আর গভীরে যেতে থাকবেন ! পুরো সিনেমাটাই অসম্ভব সব সুন্দর কথপোকথনে ভর্তি। এক দৃশ্যে নাওয়াজ বলেন, “My mother said, always said, Sometimes the wrong train takes you to the right station. তখন ইরফান বলেন, “তোমার মা? তুমি না অনাথ?” উত্তরে নওয়াজ বলেন, যেকোনো কথার আগে ‘আম্মা বলেছেন’ বললে কথাটার গুরুত্ব বেড়ে যায় ! কি অসাধারণ !

আরেক দৃশ্যে বলেন, “স্যার আপনাকে আমি প্রথম যেদিন ট্রেনে প্রথম শ্রেণীতে উঠতে দেখি, আপনার সাথে যাওয়ার জন্য আমিও উঠেছিলাম, কিন্তু টিকিট ছিলো না আমার কাছে। ভয়ে ছিলাম কখন কালেক্টর কি বলেন। তারপরের দিনই আমি প্রথম শ্রেণীর পাস করে নিয়েছি।

কেনো নিয়েছেন? যাতে তিনি তার প্রিয় স্যারের সাথেই যাওয়া আসা করতে পারেন। অথচ দুজনের মাঝে কথাবার্তা ছিলো খুবই সীমিত। শুধু অফিসের গণ্ডির ভেতর ! এটা অসাধারণ একটা দৃশ্য ছিলো।

এভাবে বর্ণনা করতে গেলে পুরো মুভিই বলে যেতে হবে। আর বেশি কিছু না বলি। বাকিটুকু দেখে শান্তি নিবেন…

ইরফান খান, নওয়াজুদ্দিন সিদ্দীকির অভিনয় নিয়ে সন্দেহ করবে, এমন কেউ আছে বলে মনে হয় না। এখানেও অসাধারণ অভিনয় করেছেন এরা। সাথে নিম্রিতা কউর, তিনিও পাল্লা দিয়ে অভিনয় করে গেছেন। সিনেমায় নিম্রিতা কউরকে বুদ্ধি দেয় এমন একজন আন্টি আছেন, তাকে অন্তত একটা দৃশ্যে দেখার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু সিনেমার কোনো দৃশ্যেই তাকে দেখা একটাবারের জন্যও দেখানো হয়নি…

অবসর নিতে যাওয়া একটা মানুষ, একজন মধ্যবয়সী মহিলা, একজন অফিস কলিগ, লাঞ্চবক্সের ভুল ডেলিভারির জন্য যে অসাধারণ কিছু হয় তা দেখতে এখনই বসে পরুন। কিন্তু অবশ্যই খালি পেটে নয়, কারণ প্রচুর ক্ষুধা লাগবে এই মুভি দেখতে গেলে। আর এজন্যই বোধহয় ইরফান খানের মুখ থেকে এই উক্তিটা বেরিয়েছে – “আমি সবসময়ই ভাবতাম মানুষটা যখন চলে যাবে তখন আমি কি করবো? কিন্তু এখন? এখন আমার শুধু ক্ষুধা পাচ্ছে!”

ইরফান খানের মত অভিনেতার আরো অনেক বছর বেঁচে থাকা দরকার ছিলো। এই মানুষটার কদর যারা করেনি, তারা ঠিকই আজ আফসোস করে বেড়াচ্ছে, আর অপরাধবোধে ভুগছে, ইশশ লোকটা বেঁচে থাকতে কেনো তা‍ঁর সিনেমা দেখলাম না !

ধন্যবাদ রিতেশ বাত্রা এরকম সুন্দর মুভি উপহার দেয়ার জন্য। ভালো থাকুক ভালোবাসার মানুষগুলো। সেটা পাশে থাক অথবা দূরে থাক…