রোয়ান অ্যাটকিনসন থেকে মি. বিন হবার গল্প !

মিস্টার বিনের নাম শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে হ্যাংলা পাতলা একজন স্যুট-টাই পরা ভদ্রলোকের কথা। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, চোখে ভেসে ওঠা দৃশ্যটা কিন্তু মোটেই মিস্টার বিন কে চেনার পরিচায়ক নয় !

মি. বিন এর নাম শোনার পর যদি আপনার ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে না ওঠে, তবে আপনি এখনো ঠিকভাবে মিস্টার বিনকে চিনেনই না। আমাদের মোটামুটি সবার ছোটবেলাকে মধুর ও রসময় করার জন্যে এই স্যুট টাই পরিহিত রোগা মানুষটাই দায়ী।

অাজ থেকে ২৮ বছর অাগে ব্রিটেনের টিভিতে প্রথম প্রচার হয়েছিলো জনপ্রিয় কমেডি শো ‘মি. বিন’ এর প্রথম পর্ব। এই মি. বিন পরবর্তীতে পরিণত হয়েছিলো পৃথিবীর সর্বাধিক জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠানগুলোর একটিতে। মানুষ হাসানোর এই কারিগর সম্পর্কে অামরা কতটুকুই বা জানি? আজ জানবো নানান প্রতিকুলতার মাঝে থেকেও একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার সেই গল্পটা ! চলুন জেনে ণেয়া যাক ‘মি. বিন’ সম্পর্কে সবরকম তথ্য…

মি. বিন এর পরিচয়

মি. বিন – পুরো নাম রোয়ান সেবাস্টিয়ান অ্যাটকিনসন। ডাক নাম রো। ১৯৫৫ সালের ৬ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের নিউক্যাসল শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম। তার বাবা এরিক অ্যাটকিনসন ছিলেন একজন কৃষক। তার মার নাম এল্লা মে। তার বড় দুই ভাই, রডনি অ্যাটকিনসন ও রুপরেট অ্যাটকিনসন। রডনি ছিলেন একজন অর্থনীতিবিদ।

ডারহামের ক্যাথেড্রাল স্কুল, নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সবশেষে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে রোয়ান অ্যাটকিনসন মাস্টার্স করেন।

অভিনয়ের প্রতি অাগ্রহ

ছোটবেলা থেকেই রোয়ান হাসিখুশি একজন মানুষ ছিলেন। তবে তিনি খুব কম কথা বলতেন। রোয়ানের ডারহামের ক্যাথেড্রাল স্কুলে একটি ফিল্ম সোসাইটি ছিলো। সেখানে ফিল্ম সোসাইটির প্রধান বিষয় ছিল হাসির ও শিশুতোষ বিষয়ক সিনেমা। স্কুলে যখন চার্লি চ্যাপলিন সহ অারও যাদের কমেডি মুভিগুলো দেখতেন, তখন থেকেই অভিনয়ের প্রতি তার অাগ্রহ জন্মাতে শুরু করে। এরপর তিনি মঞ্চের বেকস্টেজে কাজও শুরু করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি পড়াশোনা নিয়ে বেশি মনোযোগী হয়ে পরেন।

তোতলামির কারণে বারবার অভিনয়ের সুযোগ হারিয়েছিলেন মি বিন !

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে অভিনয়ের প্রতি অাবার অাগ্রহ জন্মায় রোয়ানের। তারপর একটি কমেডি গ্রুপে যোগ দেন তিনি। কিন্তু সেখানে তার কথার তোতলামির কারণে তিনি ভাল করতে পারেননি। এরপর অভিনয়ের দিকে মনোযোগী হলে সেখানেও একই সমস্যার সম্মুখীন হন তিনি। তোতলামির কারণে অনেকগুলো টিভি শো থেকে তাকে অযোগ্য ঘোষণা করে ফিরিয়ে দেয়। হতাশায় তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে। কিন্তু এরপরও তিনি নিজের উপর বিশ্বাস হারাননি।

বিনের সাথে পরিচয় হয় রিজার্ড কার্টিস নামের একজন নাট্যকার ও গীতিকার অভিনেতার সাথে। রিচার্ড সাধারণত কমেডি চরিত্রে অভিনয় করতেন। রিচার্ড কার্টিস ও রোয়ান অ্যাটকিনসন দুজনে মিলে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তোলেন ‘অক্সফোর্ড নাট্যশালা’। রিচার্ড কার্টিস ও রোয়ান অ্যাটকিনসন বিবিসি রেডিও থ্রিতে ‘দ্য অ্যাটকিনসন পিপলস’ নামের একটি স্যাটারিক্যাল ইন্টারভিউধর্মী অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতেন। ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পায় রোয়ান অ্যাটকিনসন অভিনিত মুভি ‘Dead on Time”। একই বছরের অক্টোবরে মুক্তি পায় রোয়ান অ্যাটকিনসন অভিনীত জেমস বন্ড সিরিজের ছবি ‘Never Say Never Again’ মুভিটি। মুভিটিতে রোয়ান অ্যাটকিনসন গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে অভিনয় করেন।

মি. বিন হিসেবে পর্দায় আগমণ

১৯৯০ সালের পহেলা জানুয়ারিতে ‘মি. বিন’ নিয়ে টেলিভিশন পর্দায় হাজির হন রোয়ান অ্যাটকিনসন। ‘মি. বিন’ মূলত ১৪ পর্বের একটি হাস্যরসাত্নক ব্রিটিশ টিভি ধারাবাহিক। অাইটিভি নামক একটি টেলিভিশন চ্যানেলে এর প্রথম পর্বটি প্রচারিত হয়।

মি. বিনের চতুর্থ ও শেষ পর্বটির নাম ‘Hair by Mr. Bean of London’। প্রথমে শুধু টিভি সিরিয়াল থাকলেও মি. বিন নিয়ে অসংখ্য সিনেমা এবং কার্টুনও নির্মিত হয়েছে। মিস্টার বিন প্রতিটি ক্ষেত্রেই অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। টানা বিশ বছর রোয়ান এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

মিস্টার বিন -কে অ্যাটকিনসনের বিদায়

২০১২ সালের নভেম্বরে রোয়ান অ্যাটকিনসন ডেইলি টেলিগ্রাফকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বিন চরিত্রে অার না অাসার ঘোষণা দেন। কারণ হিসেবে তিনি জানান এই চরিত্রটি তাকে দিনে দিনে শিশুতে রূপান্তর করে দিচ্ছে। এই চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলার জন্য যে শারীরিক শক্তির প্রয়োজন হয়, সেটিও তিনি পাচ্ছেন না। এছাড়া তার মতে, ‘একজন পঞ্চাশ ঊর্ধ্বের ব্যক্তিকে শিশুসুলভ অভিনয় করাটা একেবারেই বেমানান। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন থেকে অামি সিরিয়াসধর্মী চরিত্রগুলোতেই শুধু অভিনয় করবো’।

কিন্তু পরবর্তীতে তার সিদ্ধান্ত থেকে তিনি সরে অাসেন। ব্রিটেনের ডেইলি স্টার পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে রোয়ান বলেন, ‘প্রবীণ বয়সের মি. বিনকে নিয়ে আমরা কি কি করাতে পারি আর ঠিক কি রকমের হাস্যরস তার থেকে বের করে আনতে পারি, সেটা সত্যিই বেশ মজার ব্যাপার হবে। আর একজন বৃদ্ধের চরিত্রে অভিনয় করা আমার জন্যও হবে এক দারুণ অভিজ্ঞতা।’

২০১৭ সালে মুক্তি পায় তার মি. বিন সিরিজের নতুন সিনেমা ‘Huan Le Xi Ju Ren’ !

ব্যক্তিজীবনে রোয়ান অ্যাটকিনসন

১৯৯০ সালে রোয়ান অ্যাটকিনসন মেকঅাপ অার্টিস্ট সুনেত্রা শাস্ত্রির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে অাবদ্ধ হন। বেঞ্জামিন এবং লিলি নামের তাদের দুটি সন্তান রয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে রোয়ান খুবই চুপচাপ স্বভাবের। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলতে তার ভাল লাগে না। অ্যাটকিনসনের শখ হলো স্পোর্টস কার সংগ্রহ করা। মজা পান নিজের টেনিস কোটের চারপারশে তার ছোট রেসিং কার নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। ব্রিটিশ কার ম্যাগাজিনেও নিয়মিত লিখেন তিনি।

বলা বাহুল্য, রোয়ান অ্যাটকিনসন হচ্ছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা সেলিব্রিটিদের অন্যতম।

অ্যাটকিনসনের বিবাহ বিচ্ছেদ

রোয়ান অ্যাটকিনসনের সাথে সুনেত্রা শাস্ত্রির ২০১৫ সালে দুই যুগের সংসার ভেঙ্গে যায়। সংসার ভাঙ্গার কারণ হিসেবে জানা যায়, রোয়ানের অাবার প্রেমে জড়ানো। বিচ্ছেদের জন্য সুনেত্রা লন্ডনের সেন্ট্রাল ফ্যামিলি কোর্টে অাবেদন করলে মাত্র ৬৫ সেকেন্ডের শুনানিতে তার অাবেদন মঞ্জুর করেন অাদালত।

জানা যায়, রোয়ান দেড় বছর ধরে লুইস ফোর্ড নামের একজন টেলিভিশন তারকার সাথে ডেটিং করে অাসছেন। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে রোয়ান এবং লিলির প্রথম সন্তান জন্ম নেয়।

মিস্টার বিন এর আরো কিছু অর্জন

২০০৫ সালে রম্য দর্শকদের ভোটে ব্রিটিশ কমেডি ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ৫০ কমেডিয়ানের তালিকায় নাম উঠে রোয়ানের। ইংল্যান্ডের রাজনীতি এবং রাজপরিবারের বিয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে অামন্ত্রণ জানানো হয়।
ডারহামের ক্যাথেড্রাল স্কুলে রোয়ানের সঙ্গী ছিলেন টনি ব্লেয়ার (যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী)।

রোয়ান অ্যাটকিনসন অভিনিত চলচ্চিত্র সমূহ

  • ডেড অন টাইম (১৯৮৩)
  • নেভার সে নেভার এগেইন (১৯৮৩)
  • দ্য টল গাই (১৯৮৯)
  • দ্য উইচেস (১৯৯০)
  • হট শটস : পার্ট দো (১৯৯৩)
  • মি. বিন দ্য অালটিমেট ডিজাস্টার্স মুভি (১৯৯৭)
  • মে বি বেবি (২০০০)
  • স্কুবি-ডু (২০০২)
  • জনি ইংলিশ (২০০৩)
  • লাভ অ্যাকচুয়ালি (২০০৩)
  • কিপিং মাম (২০০৫)
  • মি. বিন’স হলিডে (২০০৭)
  • জনি ইংলিশ রিবর্ন (২০১১)
  • হুয়ান লি সি জু রেন (মি. বিন সিরিজ) (২০১৭)

Leave a Reply