আফিম যুদ্ধ : মাদক নিয়ে চীনের এক অদ্ভুত যুদ্ধ

ইতিহাসের অদভুত এক যুদ্ধ হচ্ছে চীনের আফিম যুদ্ধ ! মাদক নিয়ে এ যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল চীন আর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের মধ্যে। তৎকালীন চীনের স্বাধীনতাকে খর্ব করে দেয়া এ যুদ্ধটি ইতিহাসের পাতায় এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় দখল করে আছে। আফিম যুদ্ধ নিয়ে আজকে আমরা জানবো। যেহেতু অনেকেই আফিম সম্পর্কে খুব একটা জানেন না, তাই চলুন অল্প কথায় জেনে নেয়া যাক, আফিম সম্পর্কিত কিছু তথ্য…

আফিম কি? আফিম কিভাবে তৈরি হয়?

ইংরেজি ‘নারকোটিক’ শব্দের বাংলা অর্থ তন্দ্রাজনক, নিদ্রাকারক, চৈতন্য-বিলোপকারক মাদক। নারকোটিক্স বা মাদকদ্রব্যসমূহের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন অহিফেন বা আফিম।

আফিম তৈরির মূল উপাদান নেয়া হয় পপি গাছ থেকে। পপি- একই সাথে বিখ্যাত এবং কুখ্যাত একটি গাছ। সুন্দর পপি ফুলের পাশাপাশি এ গাছ থেকে যেমন ওষুধ তৈরির নানা উপাদান পাওয়া যায়, তেমনি এ গাছের ফল থেকেই তৈরি হয় সর্বনাশা মাদক আফিম।
পপি গাছের কাঁচা ফলের খোসা কাটলে যে সাদা রস পাওয়া যায় তা ২৪ ঘণ্টা রোদে শুকালে পাওয়া যায় আফিম। এর রং তখন হয়ে যায় কালো বা কালচে বেগুনী। পপি গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Papaver somniferum। এই নামকরণ করা হয়েছে গ্রীক পুরাণের ঘুমের দেবতা ‘সোমনাস’-এর নামানুসারে। কারণ পপি ক্ষেতে বয়ে যাওয়া বাতাসও প্রাণীদের ঘুম পাড়িয়ে দিতে সক্ষম!

আফিমের প্রসার

প্রায় ছয় হাজার বছর আগে থেকে মধ্যপ্রাচ্যে আফিমের ব্যবহার শুরু হয়। ব্যথা-নিবারক হিসেবে আফিম ব্যবহারের চিকিৎসাপত্র গ্রিক এবং রোমান চিকিৎসকেরা দিতে শুরু করেন যিশুখ্রিষ্টের জন্মের অনেক আগে থেকে। সপ্তম শতাব্দীতে আরব বণিকেরা ওষুধ হিসেবে আফিম পৌঁছান চীনে এবং ভারতে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে আফিম জাপান পৌঁছে। তখন ব্যথা-নিবারক হিসেবেই আফিম সেবন করা বা খাওয়া হতো। সপ্তদশ শতকে ইউরোপীয় বণিকেরা চীনের লোকদের ধূমপানে আফিমের ব্যবহার শিক্ষা দেন বাণিজ্যিক লাভের উদ্দেশ্যে। চীন দেশে সর্বপ্রথম সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর দিকে আফিম আমদানি করা হত আরব এবং তুর্কী দেশ থেকে। সে সময় চীনের মানুষ এটাকে বিভিন্ন রোগের ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করত। তখন মাদক হিসেবে এর ব্যবহার চীনা জানত না। চীনে আফিমকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হত। যেমন, ণরহম, গর-হধহম, অ-ঋঁ-ুঁহম এবং চড়-ঢ়র বা চড়ঢ়ঢ়ু।

পরবর্তীতে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে ভারত তথা বাংলাদেশ অঞ্চল থেকে প্রচুর পরিমানে মাদক চীনে চোরা চালান হত। চীনারা আফিমকে নেশা জাতীয় দ্রব্য হিসেবে খুব ভালভাবে গ্রহণ করেছিল। সে সময় নেশা জাতীয় পণ্য হিসেবে শুধু মাত্র অভিজাত ও আরামপ্রিয় লোকজন এটাকে গ্রহণ করে।

চীনের বিখ্যাত ‘আফিম যুদ্ধ’

ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের চীনে আফিম আমদানি বন্ধ করার লক্ষ্যে চীন সরকার ১৮৩৯ সালে ক্যান্টনের ব্রিটিশ গুদামের সব আফিম বাজেয়াপ্ত করে। ওই সময় কতিপয় মাতাল নাবিক চীনের এক গ্রামবাসীকে হত্যা করে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ঘাতকদের চীনের আদালতের কাছে হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৮৩৯ সালে শুরু হয় চীন বনাম ব্রিটিশ প্রথম আফিম যুদ্ধ ! এতে ব্রিটিশরা জয়ী হয়। ১৮৪২ সালের ২৯ আগস্টে স্বাক্ষরিত নানকিং চুক্তি এবং ১৮৪৩ সালের ৮ অক্টোবর স্বাক্ষরিত বোগ চুক্তিমূলে ব্রিটিশদের ব্যবসা ও বসবাসের জন্য পাঁচটি বন্দর সমর্পণে চীন বাধ্য হয়। ১৮৫৬ সালে অ্যারো নামক জাহাজে চীন সরকারের কতিপয় কর্মচারী ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশরা দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ শুরু করে। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের পক্ষে ফরাসিরাও যোগ দেয়। ১৮৬০ সালে পিকিং কনভেনশন স্বাক্ষরের মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ হয়, বিদেশিরা পিকিংয়ে দূতাবাস স্থাপন, ধর্ম প্রচারের নামে সমগ্র চীনে পরিভ্রমণ এবং অবাধে চীনে আফিম আমদানির সুযোগ লাভ করে।