কোরআনে উল্লেখিত নবীদের সংক্ষিপ্ত জীবনী (পর্ব ১)

কোরআন শরীফে উল্লেখিত নবীর সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত আছে। কারো নাম সরাসরি নবী বলে সম্বোধন করা হয়েছে, আবার কারো নাম নবীদের নামের সাথেই সম্বোধন করা হয়েছে। এখন যাঁদের নাম নবীদের সাথে উল্লেখিত হয়েছে, তাঁরা নবী কিনা সেটা নিয়েই দ্বিমত। চলুন জেনে নেই তা‍ঁদের সবার নাম এবং সংক্ষিপ্ত জীবনী…

নবীদের সংক্ষিপ্ত জীবনী

সুপ্রসিদ্ধ মতানুসারে কোরআন শরীফে উল্লেখিত নবীর সংখ্যা ২৫ জন। এরমধ্যে প্রথম ৫ জনকে নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করবো !

হযরত আদম (আঃ)

কোরআন শরীফে নবীদের মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত আদম (আঃ) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কোরআনের সবচেয়ে বড় সূরা আল-বাকারা ছাড়াও আরো ৮টি সূরায় তার বর্ণনা পাওয়া যায়।ধর্মীয় মতানুসারে তিনি ছিলেন বাহ্যিকভাবে দুনিয়ার প্রথম মানব,এবং মানব সম্প্রদায়ের আদি পিতা।

আল্লাহ ওনাকে সৃষ্টি করে প্রথমে বেহেশতে রাখেন,এবং কিছুকাল পর তার একাকীত্ব ঘুচানোর জন্য মা হাওয়াকে সৃষ্টি করেন।তারা এক সময় শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ ফল ‘গন্ধম’ ভক্ষণ করেন,এবং ফলাফল হিসেবে বেহেশত থেকে বিতারিত হয়ে দুনিয়ায় আগমন করেন।আর এটাই ছিলো স্বয়ং আল্লাহর অভিপ্রায়।এরপর ওনারা পৃথিবীতে এসে তারা বহু বছর আলাদা থাকেন,এরপর আল্লাহর ইশারায় আবার একত্রিত হন এবং সন্তান সন্ততি জন্ম দেন।তার সময়ে আপন ভাইবোনের মধ্যে বিবাহপ্রথা বৈধ ছিলো।সুপ্রসিদ্ধ মতানুসারে মৃত্যুকালে আদমের বয়স ছিলো ১ হাজার বছর।

হযরত শীষ (আঃ)

হযরত শীষ ছিলেন আদি মানব হযরত আদমের পুত্র। তার জন্মের সময় হযরত আদমের বয়স ছিলো ১৩০ বছর।

হযরত শীষ তার নিজের সন্তানাদি এবং কাবিলের সন্তানাদির কাছে হিদায়াত এবং সৎপথের আহবান জানান। (কাবীল ছিলেন হযরত আদমের সন্তান, এবং তিনি ছিলেন তার নিজের ভাই হাবিলের খুনী, এবং দুনিয়ার প্রথম খুনী)। তো এরপর কেউ কেউ হযরত শীষ এর কথা শুনে ঈমান আনলো, সৎপথ গ্রহণ করলো। কিন্তু পরে তারা অনেকেই পথভ্রষ্ট হয়ে গেলো।

হযরত শীষের উপর ৫০টির মত সহীফা কিতাব নাজিল হয়। তার ছেলেদের নাম আনুশ, কানীন এবং মাহলাইল। ইবনে কাছীরের এবং ইবনে হাইয়ানের বর্ণনানুযায়ী হযরত শীষ নবী ছিলেন। সুপ্রসিদ্ধ মতানুসারে তিনি ৯১২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

হযরত ইদরীস (আঃ)

ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত বা তোরাহ’ কিতাবে ওনাকে ‘হুনুক’ নামে সম্বোধন করা হয়েছে। উনার আগমনকাল নিয়ে ইতিহাসবেত্তাদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ বলেন ওনি বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের একজন নবী ছিলেন, আবার কেউ বলেন তিনি হযরত আদমের সপ্তম সিঁড়ির লোক ছিলেন।

হযরত ইদরীস তার নিজের পথভ্রষ্ঠ সম্প্রদায়ের নিকট ধর্মের বাণী পৌঁছান। কিন্তু গুটিকয়েক লোক ব্যতিত তার কথা কেউ শুনেনি। তবুও তিন হাল ছাড়েননি। কোরআন শরীফে ওনাকে ধৈর্যশীল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে শেষপর্যন্ত তিনি নিরাশ হন। তার এত চেষ্টা পরিশ্রম সব বিফলে যায়। এরপর তিনি তার মুষ্ঠিমেয় কিছু ধার্মিক সঙ্গী নিয়ে মিসরে নীলনদের তীরস্থ একটা খুব সুন্দর স্থানে বসতি স্থাপন করেন। এরপর সেই এলাকার পার্শবর্তী এলাকাসমুহে ধর্মপ্রচার শুরু করেন এবং তিনি তখন সফল হন।ইতিহাস থেকে জানা যায় জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিদ্যার জন্ম হয়েছিলো হযরত ইদরীসের সময়েই। যদিও প্রত্যেক নবী রাসুলদের সময়েই জ্ঞ‍ান বিজ্ঞানের অনেক শাখাই উদ্ভাবন হয়েছে।

তাওরাতের বর্ণনা থেকে জানা যায় হযরত ইদরীস বা হুনুকের বয়স যখন ৬৫ তখন তার সন্তান ‘মুতাওয়াশশালাহ’ এর জন্ম হয়। হুনুকের বয়স যখন ৩৬৫ বছর, তখন তিনি গায়েব হয়ে যান,অথবা মৃত্যুবরণ করেন।তার সন্তান মুতাওয়াশশালাহ’র বয়স যখন ১৮৭ বছর, তখন তার সন্তান লমক জন্মগ্রহণ করেন। মুতাওয়াশশালাহ ৯৬৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। এবং লমক ১৮২ বছর বয়সে এক পুত্রসন্তানের জনক হন। তার নাম রাখা হয় নূহ্ !

হযরত নূহ্ (আঃ)

আল্লাহ তায়ালা ইরাক-আরবের পথভ্রষ্ঠ লোকদের পথ দেখানোর উদ্যেশ্যর হযরত নূহ্ কে প্রেরণ করেন। কোরআন শরীফের ৪৫ স্থানে হযরত নূহ্ এর বর্ণনা এসেছে। কোথাও সংক্ষিপ্ত,কোথাও বা বিস্তারিত। (সূরা আ’রাফ, হুদ, মু’মিনুন, শু’আরা, কমর এবং নূহ্ দ্রষ্টব্য)

হযরত নূহ্ তার সম্প্রদায়ের লোকদের ধর্মের পথে আসার আহবান জানান।সমাজের লোকেরা তার কথা তো বিশ্বাস করলোই না, বরং তাকে নানাভাবে কষ্ট দেয়া এবং অপমান করা শুরু করে। বস্তুত কয়েকজন গরীব, দুস্থ লোক ব্যতীত তার প্রতি কেউ ঈমান আনেনি। এরপর হযরত নূহ্ তাদের আল্লাহর আজাবের ভয় প্রদর্শন করেন। তবুও তারা শুনলোনা। তার সূদীর্ঘ বছরের চেষ্টার পর মাত্র ৪০ জন নারী এবং ৪০ জন পুরুষ ঈমান এনেছিলো। এরপর তিনি নিরাশ হয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন,”হে আমার রব! পৃথিবীতে সত্য প্রত্যাখ্যানকারী কোনো গৃহবাসীকে অব্যাহতি দিওনা। তুমি তাদেরকে অব্যাহতি দিলে তারা তোমার বান্দাদেরকে বিভ্রান্ত করবে এবং কেবল দুষ্কৃতিকারী ও কাফির জন্ম দিতে থাকবে।”(সূরা নূহ্ঃ২৬-২৭)

আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন এবং তাকে একটা কিশতি (নৌকা) বানানোর আদেশ দেন। তাওরাতের বর্ণনানুযায়ী নূহ্ এর প্রতি আল্লাহর নির্দেশ ছিলো এরকম, “তিনশো হাত দীর্ঘ, তিনশো হাত প্রস্থ এবং ত্রিশ হাত উচ্চতাসম্পন্ন একটা নৌকা তৈরি করতে হবে, এবং সেই নৌকায় সকল ঈমানদার লোক এবং প্রত্যেক জীবজন্তুর একজোড়া করে নেবে, এবং প্রত্যেক জোড়ায় নারী এবং পুরুষ থাকবে। এবং সেইসাথে সকল প্রকার খাদ্যসামগ্রীও নিতে হবে।” হযরত নূহ্ সবকিছুই সুসম্পন্ন করেন।

যথাসময়ে আজাবের সকল আলামত প্রকাশ হলো। মুষলধারে বৃষ্টিপাত শুরু হলো, তাইগ্রীস ও ইউফ্রেতীস নদীতে ভয়াবহ বন্যা শুরু হলো,সেইসাথে পাহাড়সদৃশ ঢেউ সৃষ্টি হলো। একমাত্র নূহ এর নৌকায় যারা উঠেছিলো তারাই বেঁচে থাকলো, এবং বাকি সবাই সেই বিশাল বন্যায় প্রাণ হারালো। কথিত আছে তখনকার সময়ের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের উপরেও ৪০ হাত পানি উঠেছিলো।

এরপর ৪০ দিন পর বর্ষণ থেমে যায় এবং ১৫০ দিন পর হযরত নূহ্ এর নৌকা জুদী পর্বতে স্থির হলো। তাওরাতের জন্ম পুস্তকের ৬ষ্ট অধ্যায়ের ৪র্থ পংক্তিতে বলা হয়েছে নূহ্ এর নৌকা আরারত পর্বতে স্থির হয়। আরারত বিরাট একটি পর্বতের নাম যা ইরান, রাশিয়া ও তুর্কিস্থানের সীমান্তে অবস্থিত। আর যে অংশের নাম আরারত তা তুর্কিস্থানের সীমান্তে অবস্থিত।

আর যে অংশের নাম আরারত তা তুর্কিস্থানের সীমান্তে অবস্থিত। যে স্থানে নৌকা স্থির হয়েছিলো, কোরআনে ঠিক সেই স্থানটির নামই বলা হয়েছে। আর সে স্থানটি হলো জুদী। ইরানীরা পাহাড়ের সেই অংশটাকে ‘কুহে নূহ্’ বলে ডাকে।

হযরত নূহ ৯৫০ বছর জীবিত ছিলেন। কোরআনে বলা হয়েছে,”অতঃপর নূহ্ তাদের মধ্যে ৫০ কম ১০০০ বৎসর অবস্থান করেছেন।” (সূরা আনকাবুতঃ১৪) প্লাবন এসেছিলো যখন,তখন তার বয়স ছিলো ৬০০ বছর। তার ছেলে কেনান ছিলো ধর্মান্তরিত। সে প্লাবনে মারা যায়। এছাড়াও ওনার হাম, শাম এবং ইয়াফেস নামে আরো তিনজন ধার্মিক পুত্র ছিলো। হামের চার পুত্র ছিলো, তাদের নাম কুশ, মাসরাইম, কেনান ও ফুলু। বাদশাহ নমরুদ ছিল কুশের বংশধর। শামের পুত্র ছিলো পাঁচজন। তাদের নাম ইলাম, লুদ, আশুর, আরাম ও আরফনহাশদ। হযরত ইব‌রাহীম (আঃ) আরফনহাশদের বংশধর ছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) সেই মহাপ্লাবনের ৩৩৭৫ বছর পর দুনিয়াতে আগমন করেন। (রাহমাতুল্লিল আলামীন-১২৪ পৃষ্ঠা)

  • আপনি পড়ছেন : কোরআনে উল্লেখিত নবীদের সংক্ষিপ্ত জীবনী (পর্ব ১)

হযরত হূদ (আঃ)

আল্লাহ হযরত হূদকে আ’দ জাতীর পথপ্রদর্শনের জন্য প্রেরণ করেন। তাদের নিবাস ছিলো ইয়েমেন থেকে শুরু করে পারস্য সাগরের তীরবর্তী দক্ষিণ আরবের বিস্তীর্ণ এলাকা। ধারণা করা হয় বর্তমান ইয়েমেন, হাদরামাউত, আম্মান ও কাতার বিভিন্ন এলাকায় তাদের নিবাস ছিলো। তাদের মূর্তিগুলোর নাম ছিলো অদ, সুয়া, ইয়াগুস, ইয়ায়ুক ও নসর।

তখনকার সময়ে আ’দ জাতী ছিলো বেশ উন্নত একটা জাতি। তাদের উর্বর জমিন ছিলো, গৃহপালিত পশু ছিলো, পানির ব্যবস্থা ছিলো। তাদের সম্পর্কে কোরআন শরীফে বলা হয়েছে, “ভয় করো তাকে, যিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন সে সমুদয় যা তোমরা জানো। তোমাদেরকে দিয়েছেন গুহপালিত চতুষ্পদ জন্তু ও সন্তান সন্ততি আর উদ্যান ও প্রস্রবণ।”

আ’দ জাতি স্থাপত্য বিদ্যায় ছিলো পারদর্শী। তাদের তৈরি দালান কোঠা ছিলো দৃষ্টান্তহীন, অতুলনীয়। কোরআনে বলা হয়েছে,”তুমি কি দেখোনি, তোমার প্রতিপালক কি করেছেন আ’দ বংশের ইরাম গোত্রের প্রতি, যারা অধিকারী ছিলো সুউচ্চ প্রাসাদের, যার সমতূল্য কোনোদেশে কোনোকিছু নির্মিত হয়নাই।” (সূরা ফাজরঃ৬-৮)

বস্তুত তাদের এই শানশওকত ও শ্রেষ্ঠত্বই তাদেরকে অহংকারী, অত্যাচারী ও আল্লাহদ্রোহী শক্তিতে পরিণত করেছিলো। ঠিক তখনি আল্লাহ হযরত হূদকে পাঠান। হযরত হূদ তার জাতি আ’দ কে তাওহীদ শিক্ষা দিতে শুরু করেন। কিন্তু পাপকাজ তাদের অন্তরের মাঝে এমনই কঠিনভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলো যে তারা হেদায়েতের বাণীগুলো শুনতেই পছন্দ করত না। বরং তাকে প্রত্যাখ্যান করলো এই বলে যে – “তোমার তো কোনো আকল নেই” !

যখন হূদ বুঝতে পারলেন আর কাজ হবেই না, তখন তিনি আল্লাহপ্রদত্ত মহাশাস্তির কথা স্মরণ করালেন। তখন আ’দ জাতি আরো কঠোরভাবে হূদের বিরোধিতা করতে থাকে এবং তার উপর নানারকম মিথ্যে আরোপ দেয়। এরপর আল্লাহর তরফ থেকে তাদের উপর গজব নেমে আসে। তাদের তৈরি সুইচ্চ প্রাসাদ ভেঙে খান খান হয়ে যায়। দীর্ঘ তিনবছর সময় ধরে চললো খরা এবং অনাবৃষ্টি, ফলে নেমে এলো ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। এরপর এলো ‘কালোমেঘ’ নামে একপ্রকার গজব। নেমে এলো প্রচন্ড ঝড়। সেই ঝড় তাদের ধ্বংসস্তুপে পরিণত করলো। তারা যেখানে বাস করতো সেখানে বালির পাহাড় ব্যতীত আর কিছুই ছিলো না।

আ’দ জাতীর ধ্বংসের পর হূদ এবং তার ধার্মিক সঙ্গীরা হাদরামাউতে হিজরত করেন। এবং তিনি সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। হাদরামাউতের উত্তর সীমান্তে তারইম এ হযরত হূদ এর কবর অবস্থিত। যদিও কেউ কেউ বলেন তার কবর ফিলিস্তিনে অবস্থিত। এমনকি সেখানে বার্ষিক ওরশও হয়ে থাকে। তবে এই বর্ণনার কোনো প্রমাণ ইতিহাসে নেই।

নবীদের সংক্ষিপ্ত জীবনী নিয়ে দ্বিতীয় পর্বটি আগামীকাল প্রকাশিত হবে।