চুয়াডাঙ্গা জেলার বিখ্যাত সব দর্শনীয় স্থানগুলো

বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল চুয়াডাঙ্গা জেলা। একসময় এটি কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত ছিলো। এবং দেশ বিভাগের পূর্বে এটি পশ্চিম বঙ্গের নদিয়া জেলার অন্তর্গত ছিলো। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, চুয়াডাঙ্গা জেলাটি সবসময়ই আলোচনার বাইরে থাকে। আবার এমনও আছে, এই জেলার নাম শুনলে হা করে তাকিয়ে থাকেন। জানেনই না যে এই নামে একটি জেলা রয়েছে ! অথচ এই চুয়াডাঙ্গায় রয়েছে ভ্রমণপিপাসুদের দেখার তৃষ্ণা মেটানোর জন্য অসংখ্য অপরূপ দর্শনীয় স্থান !

চুয়াডাঙ্গার এরকমই কয়েকটি বিখ্যাত ও দর্শনীয় জায়গাগুলো সম্পর্কে আজকে আমরা জানবো। পড়ুন ছারপোকার বিশেষ এই প্রতিবেদন…

একনজরে চুয়াডাঙ্গার দর্শনীয় স্থান

প্রথমেই জানিয়ে রাখি, চুয়াডাঙ্গার প্রসিদ্ধ স্থাপনাসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট চুয়াডাঙ্গা বড় মসজিদ, ঘোলদাড়ি মসজিদ (নির্মাণসাল ১০০৬ খ্রিস্টাব্দ), জামজামি মসজিদ, ঠাকুরপুর মসজিদ, শিবনগর মসজিদ, হাজারদুয়ারি স্কুল (দামুড়হুদা), কার্পাসডাঙ্গা নীলকুঠি, ঘোলদাড়ি নীলকুঠি ইত্যাদি।

কার্পাসডাঙ্গা

কার্পাসডাঙ্গা, নীলকুঠি

কার্পাসডাঙ্গা, নীলকুঠি

কার্পাসডাঙ্গা একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী গ্রাম, যেটি পশ্চিমবঙ্গের সাথে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। স্থানীয় ব্যাবসাকেন্দ্র হিসেবে এটি বহু বছর ধরে সুপরিচিত ছিলো। ভৈরব নদীর তীরবর্তী বাজারটি মুঘল আমল থেকে ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত অন্যতম প্রাচীন বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত ছিলো। ভৈরব তীরবর্তী নীলকুঠিটিও কালের সাক্ষ বহন করছে। এই এলাকায় নীলচাষ পরিচালনা করার জন্য এটি তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্যতম প্রধান ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হত।

কেরু এন্ড কোং

দর্শনা কেরু এন্ড কোং লিঃ

দর্শনা কেরু এন্ড কোং লিঃ

ঐতিহ্যবাহী দর্শনা কেরু এন্ড কোং লিঃ হচ্ছে এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম চিনিকল, যা বৃটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি একটি উৎকৃষ্ট ‍মানের পিকনিক স্পট। দুইতলা ভবন বিশিষ্ট মনোরম গেস্ট হাউজ রয়েছে এখানে।

যেভাবে যাবেন : চুয়াডাঙ্গা শহর থেকে বাস অথবা ট্রেন যোগে দর্শনা যেতে হবে। দর্শনা শহরেই অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী কেরু এ্যান্ড কোং লিঃ।

নাটুদহ আটকবর

নাটুদহ আটকবর

নাটুদহ আটকবর

নতিপোতা ইউনিয়নের নাটুদহ গ্রামে ১৯৭১ সালের ৫ই আগস্ট পাক সেনাদের সাথে সন্মুখযুদ্ধে শহীদ আটজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর বিদ্যমান যা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আটকবর নামে ঐতিহাসিক মর্যাদা লাভ করেছে। শহীদ আটজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হলেন – আলাউল ইসলাম খোকন, হাসান জামান, আবুল কাশেম, রওশন আলম, রবিউল ইসলাম, আফাজ উদ্দিন, খালেক সাইফুদ্দিন তারেক ও কিয়ামুদ্দিন।

যেভাবে যাবেন : চুয়ডাঙ্গা শহর থেকে দামুড়হুদা উপজেলা। দামুড়হুদা উপজেলা শহর থেকে বাসযোগে নাটুদহ আটকবর যেতে হবে।

গড়াইটুপি অমরাবতী মেলা

অমরাবতী মেলা

অমরাবতী মেলা

হযরত খাজা মালিক উল গাউস (রাঃ) নামে এক সাধক চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের গড়াইটুপি গ্রামে একটি নির্জন মাঠে আস্তানা গড়ে তোলেন। সেখান থেকে তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচার করতেন। এলাকায় পীর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। সেখানেই তিনি বাংলা সনের ৭ আষাঢ় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গড়াইটুপি গ্রামের মাঠে তার মাজার আছে। প্রতিবছর ৭ আষাঢ় হযরত খাজা মালিক উলগাউস (রাঃ) স্মরণে সাত দিন ব্যাপী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। যা মেটেরী মেলা নামে পরিচিত।

ঘোলদাড়ী জামে মসজিদ

ঘোলদাড়ী জামে মসজিদ

ঘোলদাড়ী জামে মসজিদ

আলমডাঙ্গা উপজেলা ঘোলদাড়ী গ্রামে মহাম্মদ ঘোরীর আমলে ১০০৬ সালে ওমর শাহ নামে এক ধর্মপ্রাণ দরবেশ একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদটি ঐতিহাসিক মসজিদ হিসাবে এখানে পরিচিত। এই মসজিদটি দেখার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে আজও ‌আবির্ভাব ঘটে অনেক পর্যটকের। এখনো এই মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় হয় ।

যেভাবে যাবেন : চুয়াডাঙ্গা জেলা শহর থেকে বাস অথবা ট্রেন যোগে আলমডাঙ্গা তারপর আলমডাঙ্গা থেকে রিকসা বা ভ্যান যোগে ঘোলদাড়ী বাজার। ঘোলদাড়ী বাজার থেকে ১ কিঃ মিঃ যেয়ে ঘোলদাড়ী মসজিদ অবস্থিত।

তিয়রবিলা বাদশাহী মসজিদ

তিয়রবিলা বাদশাহী মসজিদ

তিয়রবিলা বাদশাহী মসজিদ

অতি প্রাচীন এই উপজেলার খাসকররা ইউনিয়নে তিয়রবিলা গ্রামে গড়ে উঠেছিল এক বাদশাহী মসজিদ যা পুরাকৃীর্তির এক সুন্দর নিদর্শন । নাটরের জমিদার রানী ভবানী এই মসজিদটি বহু অর্থের বিনিময়ে সংস্কার করেন । এবং এই মসজিদরক্ষণা বেক্ষণের জন্য ২৫ একর জমি ওয়াকফো করে দেন । মসজিদটি এতদাঞ্চলে ধর্মীয় ঐতিহাসিক নিদর্শন।

যেভাবে যাবেন : চুয়াডাঙ্গা জেলা শহর থেকে বাস অথবা ট্রেন যোগে আলমডাঙ্গা উপজেলা তারপর আলমডাঙ্গা থেকে রিকসা বা ভ্যান যোগে খাসকররা ইউনিয়নের তিয়রবিলা গ্রামে মসজিদটি অবস্থিত।

তালসারি সড়ক

তালসারি সড়ক

তালসারি সড়ক

মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা জেলাকে দুই ভাগ করেছে মোনাখালি-চুয়াডাঙ্গা সড়ক। এ সড়কের পূর্বদিকে চলে যাওয়া রাস্তার নাম তালসারি সড়ক। এটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গার ঐতিহাসিক সড়ক। অবিভক্ত বাংলার জমিদারি শাসনামলে এ সড়ক গড়ে তোলার পেছনে তৎকালীন জমিদার নফর পালের স্ত্রী রাধারানীর ভূমিকা অগ্রগণ্য। তাঁর ইচ্ছা পূরণ করতেই এই পাখি ডাকা, ছায়াঘেরা সড়ক তৈরি করা হয় এমনটি বলেছেন ইতিহাসবিদরা !

ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, এ অঞ্চলের জমিদার ছিলেন নফর পাল। তিনি ছিলেন ক্ষ্যাপাটে প্রকৃতির। তাঁর স্ত্রী রাধারানী ছায়াঘেরা পথে কৃষ্ণনগর যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। রাধারানীর ইচ্ছা পূরণ করতে জমিদার নফর পাল নাটুদহ থেকে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত সড়ক ছায়া সুনিবিড় করার উদ্যোগ নেন। তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলেও প্রায় ১২ কিলোমিটার রাস্তার সঙ্গে এক কিলোমিটার পর পর ফলবাগান গড়ে তোলা হয়। এছাড়াও রাস্তার দুই পাশে বিভিন্ন জাতের গাছ রোপণ করা হয়। কালক্রমে আম, জাম, কাঁঠাল, কলা ইত্যাদি গাছের সবই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে; কিন্তু বহুবর্ষজীবী হওয়ায় ওই সময় লাগানো তালগাছগুলো এখনো একপায়ে দাঁড়িয়ে পথিককে ছায়া আর ফল দিয়ে যাচ্ছে। নাটুদহ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল মান্নান জানান, এলাকার ক্ষ্যাপাটে জমিদার নফর পালের কর্মকাণ্ডের সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছে এসব তালগাছ। এগুলো শুধু ছায়া দেয় না, এলাকার অনেকের জীবন-জীবিকাও সচল রেখেছে। তিনি আরো জানান, সৌন্দর্যমণ্ডিত সরকারি এ সড়কের দুই পাশের তালগাছ থেকে অনেকে শীতকালে রস সংগ্রহ করে তা বেচে সংসার চালায়। মহাজনপুর গ্রামের শ্রমজীবী হালিমা জানান, তাঁর স্বামী মৌসুমের তিন মাস তালের রস সংগ্রহ করে তাঁদের সংসারের অভাব মেটান। প্রাকৃতিক শোভাবর্ধনকারী এই তালসারিতে আশপাশের গ্রামের ছেলেমেয়েরা বনভোজন করতে আসে। জমিদার নফর পাল নেই, নেই তাঁর স্ত্রী রাধারানী; কিন্তু তালসারি সড়ক তাঁদের পরিচয় বহন করছে।

পরিশেষে,

ভালো লাগার মত আরো অনেক কিছু আছে চুয়াডাঙ্গা জেলায়। কক্সবাজার রাঙ্গামাটি ভারত নেপাল তো অনেক গেলেন। নিজের দেশের ছোট্ট অঞ্চল চুয়াডাঙ্গায় এবার যাচ্ছেন তো?