খুব শীঘ্রই ‘দুর্লভ’ হতে চলা ঢাকার কিছু দৃশ্য

শুধু নব্বই দশকে ঘিরেই যে আমাদের সব সুখস্মৃতি বা আমাদের যত অতীত, ‍তা কিন্তু নয়। উনিশের চৌকাঠ পেরিয়ে বিশের ঘরে আসা ২০০০ সাল বা ২০০০ পরবর্তী সময়েও আমরা ঢাকা শহরের এমন কিছু দৃশ্য বা এমন কিছু জিনিসের সাথে পরিচিত হয়েছি, আজকের ২০২০ সালের নতুন দৃশ্যপটে এসে যা খুব অচেনা লাগে। খুব বড় কিছু নয়। একেবারেই ছোটখাট কিছু জিনিস, বা সাধারণ কোনো বিষয়…

খুব সম্ভবত অল্প পাওয়া বা চাহিদার সীমাবদ্ধতার ‍কারণেই আমাদের আবেগ ভালোবাসাটা শুধু মানবকেন্দ্রিক না হয়ে গড়ে উঠেছিলো এই ক্ষুদ্রতর বিষয়গুলো নিয়ে। সেটা হতে পারে পিরিচে টোস্ট বিস্কিট রাখা একটা চায়ের কাপ। অথবা এলাকার মুদি দোকানের দু ফিট পরের মুরগির দোকানটা। খাঁচার ভেতর থেকে বের হয়ে আসা মুরগির মাথা ধরে টানাটানি কর‍ার মত ভয়‍ানক ব্যাপার। এসবই ছিলো আমাদের শৈশবের সুখগাঁথা। নব্বই দশকটা যদি সুখের শুরু হয়, তাহলে সেই সুখের শেষাংশটা এই ২০০০ -এ এসে শুরু হয়েছে।

কথ‍া না বাড়িয়ে চলুন শৈশবে ফিরে যাই। দেখে আসি, ঢাকা থেকে কোন কোন দৃশ্যগুলো অল্প কয়েক বছরের মাঝেই দুর্লভ হতে চলেছে…

খুব শীঘ্রই দুর্লভ হতে চলা ঢাকার কিছু দৃশ্য

পিরিচের উপর সাজিয়ে রাখা এক কাপ চা আর এক পাশে দু-চারটা টোস্ট বিস্কুট। একসময় দেখতাম আমাদের মা, খালারা এভাবেই বাসার নিয়মিত আগন্তুকদের (প্রাইভেট টিউটর, পাশের বাসার আন্টি) আপ্যায়ন করতেন। আমরা খুব সতর্ক থাকতাম ট্রে ধরার সময়। যাতে ডানে বামে কাত হয়ে চায়ে বিস্কিট ভিজে না যায়। এভাবে চ‍া বিস্কিট পরিবেশন করার দৃশ্যটা এখন প্রায় বিরল !

Photo Credit: Inge Colijn

লেখার শুরুতেই যে ‍মুরগির দোকানের স্মৃতিচারণ করছিলাম। এটা তারই ছবি। সদ্য গড়ে ওঠা ঢাকার ওলিতে গলিতে একটা সময় এরকম মুরগির দোকান দেখতে পাওয়া যেত। বিষ্ঠার গন্ধে দোকানগুলোর সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যেত না। তব‍ুও আমরা বাবার হাত ধরে অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে থাকতাম মুরগি জবাই করার দৃশ্যটা দেখার জন্য। মহল্লার গলিতে এখন একে তো আর এরকম দোকান দেখা যায়ই না। তার উপর বড় বড় বাজারগুলো থেকেও এই জালি দিয়ে বোনা বেতের খাঁচাগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সবখানে এখন ইস্পাতের খাঁচা দেখা যায়। যদিও কিছু কিছু জায়গায় ব্যতিক্রম।

শেষ কবে এরকম রঙবেরঙের খেলনার দোকান দেখেছেন বলুন তো? একটা সময় ঢাকার বুকে অসংখ্য মাঠ ছিলো। বিকেলবেলা মানুষজন সেখানে হাঁটাহাঁটি করত। বাচ্চারা খেলাধুলা করত। এসব জায়গাগুলোকে ঘিরে জমে উঠেছিলো খেলনার দোকান, মুড়ি মুড়কি এবং চটপটি-ফুচকার দোকানগুলো। পার্ক বা মাঠগুলোর বাউন্ডারির বাইরে ঘুরে বেড়াত সামনে চাকাওয়ালা আইসক্রিমের গাড়ি। পহেলা বৈশাখ, বছরের দুটো ঈদ, স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবসে এসব জায়গায় মেলা বসত। তখন পুরো মাঠ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত এরকম খেলনার দোকানগুলোয়। সেখানে মাটির পুতুল, কাপড় ও ফোমের পুতুল, খেলনা পিস্তল, পাজল এবং সবচেয়ে দামী খেলনা হিসেবে ক্যালকুলেটর আকারের ভিডিও গেমস প্লেয়ার বিক্রয় হত।

হাওয়াই মিঠাই। বেশিরভাগ মানুষই স্বীকার করতে বাধ্য হবেন, ছোটবেলায় তারা এই জিনিসটার নাম জানতেন না। খেতে মন চাইলে শুধু বাবাকে বল‍া যেত, আমি ওই জিনিসটা খাবো। বেলুনের মত পলিথিনে পেঁচানো, ভিতরে লাল রং !

আসলে এই হাওয়াই মিঠাই জিনিসটাকে আমাদের বাবা মায়েরা খুব এড়িয়ে চলতেন। কারণ তাদের ধারণা ছিলো, প্রচুর পরিমাণ রং, স্যাকারিন আর ক্ষতিকর কেমিক্যাল দিয়ে এই জিনিস তৈরি করা হয়। তাই এটাকে একরকম নিষিদ্ধ খাবার বানিয়ে নাম পর্যন্ত গোপন রাখা হত। নাম নিয়ে এই অভিজ্ঞতা সকলের হয়েছে কিনা জানিনা। অন্তত আমার এবং আমার আত্মীয়স্বজন ও আমার দেখা কয়েকটা বন্ধুবান্ধবের পরিবারের সাথে এমনটাই ঘটেছিলো। নিষিদ্ধ খাবারের নাম বাচ্চাদেরকে বলা যাবেনা !

হাওয়াই মিঠাই’র সাথে এই জিনিসটাও যোগ করা যায়। এটার নাম আ‍মার জানা নেই। কখনো খাওয়ার সৌভাগ্যও হয়নি। শুধু দেখেই গেছি সংসদ ভবনে। তাও ২০০৩-০৪ এর দিকে। নামটা কারো জানা থাকলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সে জানাবেন।

শৈশবে রাতের ঢাকা শহরটা ছিলো আমাদের কাছে অচেন‍া। ঢাকা শহরের ছেলেমেয়েরা সচরাচর স্কুলে যাওয়া ছাড়া আর তেমন কোনো প্রয়োজনেই বাইরে যেতে পারত না। গেলেও তা বাড়ির আঙ্গিনা বা আশেপাশের দুয়েকটা দালান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিলো। তবে কখনো পরিবারের সাথে ঘুরতে বের হলে বা কোনো দাওয়াতে গেলে বাড়ি ফিরতে যদি রাত হত, তাহলে ঢাকার এই দৃশ্যগুলো চোখে পড়ত। অসুখ বিসুখের সময় সন্ধ্যার পর বাবা যখন ‍ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেত, তখন চোখ বড় বড় করে আমরা উপভোগ করতাম ফুটপাতের এই দোকানগুলো। বাদাম বুট আর শিমের বিচি বিক্রি করা এই দোকানগুলোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আঙ্গুলে বিটলবণ মাখানোর লোভ সামলাতে পেরেছে, এমন বাচ্চাদের সংখ্য‍া খুবই কম। ২০১৯ সালের ঢাকার রাস্তা আজ এই শোভাগুলো হারিয়ে ফেলেছে। বাদামওয়াল‍া মামাদের কেরোসিনবাতির আলো ছাড়া বড়ই যান্ত্রিক আজকের ঢাকা শহর…

এখনকার বাজারে এক টাকায় একটি চকলেট পাওয়া যায়। ১ টাকার কয়েন বাজারে অভাব নেই। একটি আট আনার দুই আধুলি অথবা চার আনার প‍ঁচিশ পয়সার দুইটি সিকি মিলে একসাথে হত এক টাকা। এখনকার ভিক্ষুকরা ১ টাকার কয়েন দিলে ভিক্ষা নিতে নারাজ হয়। অথচ একসময় চার আনা বা ২৫ পয়সা দিলেও ভিক্ষুকরা নিয়ে নিত। খুব আগের কথা নয়। ৯৮ সালের কথা বললাম !

অবাক হলেন? তাহলে আরেকটু বলি, আজ থেকে প্রায় ৮০-৯০ বছর আগে এদেশে পোয়া পয়সা, আধা পয়সার প্রচলন ছিলো। মুদ্রার মূল্যায়ন হ্রাসের কারণে ধীরে ধীরে পোয়া ও আধা পয়সার প্রচলন উঠে যায় । ব্রিটিশ আমলে চালু হওয়া এই পোয়া পয়সা ও আধা পয়সা তামা দিয়ে তৈরি হত। এর কিছু বছর পর এগ‍ুলোর পাশাপাশি এক পয়সা , দুই পয়সা, এক আনা, দুই আনা, সিকি, আধুলি এবং এক টাকা মূল্যমানের ধাতব মুদ্রা প্রচলন করা হয়। ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ দিকে পোয়া ও আধা পয়সার প্রচলন উঠে যেতে থাকে। পাকিস্তানি শাসন আমলে সর্বনিম্ম  এক পয়সার প্রচলন ঘটে। উপরের ছবিতে একটা ফুটা পয়সা দেখতে পাচ্ছেন? এই কয়েনগুলো এখন একেবারেই বিরল। তামা দিয়ে তৈরি এই এক পয়সার মাঝে গোলাকার ছিদ্র ছিলো। ২০০৩ সালে এই কয়েন হাতে পেয়েছিলাম। মূল্যায়নটা বুঝতে না পারায় সংরক্ষণে রাখতে পারিনি।

একাত্তরের স্বাধীনতার আগেই ধাতব পয়সার প্রচলন ঘটে। তবে স্বাধীনতার পর আর এই ১ পয়সা, ২ পয়সায় কোনো সওদা মিলতো না। বাংলাদেশ ব্যাংক এগুলো বাজার থেকে উঠিয়ে নেয়। পাঁচ পয়সা ও দশ পয়সার মুদ্রা তৎপরবর্তীতে উঠিয়ে নেয়া হলেও সরকারীভাবে চালু থেকে এখন প্রয়োগে অনুপযোগী।

জেনে অবাক হবেন, এখনো পঁচিশ পয়সা ও পঞ্চাশ পয়সার ধাতব মুদ্রা চালু রয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনুপযোগী। ওইযে বললাম, এক টাকার কয়েন দিলেই ভিক্ষুকরা নিতে চায় না। গালমন্দ, অভিশাপ দিতে দিতে চলে যায় !

শেষ কবে সিঙ্গারা সমুচা খেয়েছেন সত্যি করে বলুন তো? বাইরে পিৎজ্জা বার্গার তো ঠিকই খেতে যান। এখন তো আর লাঞ্চ আওয়ারেও সিঙ্গারা ছুঁয়ে দেখেন না। শহরজুড়ে নত‍ুন নতুন রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। বিদেশি খাবারের অনুকরণে নতুন নতুন খাবার সবার নজর কাড়াচ্ছে। ঠিক আছে, এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে দেশীয় খাবারের কথাটাই একেবারে ভুলে যেতে হবে? নব্বই দশকের ছেলেমেয়েরা জীবনের একটা দীর্ঘ সময় এই সিঙ্গারা খেয়ে কাটিয়েছে। অস্বীকার করতে পারবে কেউ? স্কুলের ক্যান্টিন অথবা বাসায়, বেলা ১২টা বাজার কয়েক মিনিট এদিক ওদিক। নাস্তার প্লেটে হাজির হয়ে যেত সিঙ্গারা সমুচা আর সিজান/আহমাদ ব্রান্ডের সস।

সিঙ্গারাকে নানান রকম স্বাদ দিয়ে ধরে র‍াখা যেত। আফসোস, রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা এগিয়ে এলো না। এখনো ঢাকার অনেক জায়গায় কলিজা সিঙ্গারা, টাকি মাছের সিঙ্গারা সহ নানারকমের সিঙ্গারা পাওয়া যায়। অল্প কয়েকবছরের মাঝেই এই জিনিস বিলুপ্ত হয়ে যাবে, জেনে রাখুন।

জিলাপী যে প্রায় হারিয়ে গেছে, তাতে কোনো সন্দেহ আছে? শেষ কবে আপনার জিলাপী খেতে মন চেয়েছে বলুন তো? ১৯৯৮ সালের দিকে বাসায় মেহমান এলে পুরান ঢাকার বিখ্যাত এবং ঐতিহ্যবাহী শাহী জিলাপী নিয়ে আসত। জিলাপী ছাড়াও আরো নানারকম মিষ্টি, চমচম, দই বা রসমালাই জাতীয় মিষ্টান্ন নিয়ে অন্যের বাসায় যাওয়ার প্রচলণ ছিলো। ঐতিহ্যের প্রতি সবার হুট করে কেনো অনিহা চলে এলো, ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারিনা। এখন রমজান মাসে ইফতারির সাথেও বাবা আর জিলাপি খুঁজেন না। শহরের ‍নামীদামী কেক পেস্ট্রি আর ডেজার্টের লোভনীয় স্বাদের কাছে আমাদের ঐতিহ্যরা বোধহয় হারতে হারতে একেবারে হারিয়েই গেলো !

নানান রকম ঐতিহ্যবাহী খাবারে সমৃদ্ধ ছিলো আমাদের ইতিহাস। শুধু ঢাকার কথাই বলবোনা। দেশের প্রতিটা জেলায়ই কিছু ‍না কিছু বিখ্যাত খাবার ছিলো। এখন নেই। একেবারে নেই বলা যাবেনা। আছে, তবে না থাকার মতই। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারের কথা বাদ দিচ্ছি। শুধুমাত্র ঢাকার রাস্তায় যেসব ভাজাপোড়া, টিক্কা, চাপ আর কাবাব পাওয়া যেত, সেগুলোর মধ্যে কয়টা নাম বলতে পারবেন আপনি? জালি কাবাব, কাঠি কাবাব, শাম্মি  কাবাব, বটি কাবাব, নার্গিস কাবাব, শিক কাবাব ঘুরেফিরে এগ‍ুলোর নামই চলে আসবে। আসুক, সমস্যা নেই। অন্তত এই খাবারগুলো শহরজুড়ে সহজলভ্য হলেও মানা যেত। যেখানে পুরান ঢাকায়ই এখন আর এসব খাবার ঠিকমত পাওয়া যাচ্ছেনা !

পথচারীদের জন্য ঢাকার রাস্তায় এখন জায়গা করে নিয়েছে নুডলস, চিকেন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর পোঁড়া তেলে গরুর বট ভাজা ভ্রাম্যমাণ গাড়ি। অভিজাত এলাকাগুলোয় রয়েছে অভিজাত রেস্তোরা। ঐতিহ্য নিয়ে ভাবতে যাবে, কার এত ঠেকা পরেছে !

তবে হ্যাঁ, শহরের বুকে অলিতে গলিতে এখনো কিছু দোকান আছে, সেই ছোটবেলা থেকে যাদেরকে নানান রকম ব‍াহারি কাবাব আর মাংস বটি বানাতে দেখেছি। এখনো কিছু নিম্নমানের হোটেলে আলু কুচিকুচি করে কেটে হালকা ঝোল রেখে আলুভাজি বানায়। আটার রুটি দিয়ে সেই আলুভাজি খেতে সত্যিই ব্যতিক্রম লাগে।

বছর পাঁচেক আগেও ভার্জিন লিখে গুগলে সার্চ দিলে বাংলাদেশ থেকে ভার্জিন নামক সফট ড্রিংকসটার হারিয়ে যাওয়ার গল্প আসত। এখন ভা‍র্জিন লিখে সার্চ দিলে চটি গল্প চলে আসে। ইউটিউবের ভালগার কন্টেন্ট চলে আসে। খুব শীঘ্রই দুর্লভ হতে যাওয়া এই তালিকায় ভার্জিনের কথা না টানলেও হত। তবুও স্মৃতিচারণ যেহেতু করেছি, সেহেতু ভার্জিন পোকোলা ভিটা কোলা স্লাইস এসবের নাম না বললেই নয়।

ভিটা কোলা নিয়ে এই ছবিটা অনেকদিন যাবৎ ফোনে জমা পরে আছে। কোন এক ফেসবুক গ্রুপে যেনো পেয়েছিলাম। ছবিটা দিয়ে যাই। এটা কোথায় তোলা হয়েছে, তা নিয়ে অনেক কৌতুহল আছে। কেউ জানলে কমেন্ট বক্সে উত্তর দিয়ে যান…

 

আরও অনেকগুলো ছবি নিয়ে বসেছি। লেখার আগ্রহ নেই। জীবন থেকে তো কতকিছুই হারিয়ে যায়। শহর থেকে আর কয়টা জিনিস হারিয়ে গেলে কিই বা হবে !  হারিয়ে যাওয়া গল্পগ‍ুলো নোটবুক সহই ‍হারিয়ে যাক…