মিশা-জায়েদ’ই ইন্ডাস্ট্রির যোগ্য নেতা !

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন শেষে বাংলাদেশ এফডিসি নতুন নেতা পেয়ে গেলো। জয়ী প্রার্থীদের নিয়ে চারিদিকে চলছে অনেক আলোচনা-সমালোচনা৷ সেই ধারাবাহিকতায় গোটা নির্বাচনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে আমিও আমার ব্যক্তিগত মতামত তুলে ধরার চেষ্টা করলাম…

যেসব কারণে মিশা-জায়েদ ইন্ডাস্ট্রির যোগ্য নেতা

শিল্পী সমিতির নির্বাচনে মিশা-জায়েদ পাশ করার পর চারিদিকে চলচ্চিত্র দর্শকদের হা-হুতাশ দেখে মনে হচ্ছে, মিশা-জায়েদের বিপরীতে ছিলেন টম ক্রুজ আর অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।

চলুন প্রথমে দেখা যাক, সাধারণ সম্পাদক পদে কে কে ছিলেন। জায়েদ খান আর ইলিয়াস কোবরা। জায়েদ যদি এই পদের জন্য এতটাই অযোগ্য হন, তাইলে ইলিয়াস কোবরা কি এমন কারণে এই পদে জায়েদের চেয়েও যোগ্য? একটা কারণ বলেন…

জায়েদ অভিনয় পারে না, তার কোনো ভালো সিনেমা নেই। এসব আলাপ এই নির্বাচনে টানা একদম বোকার মত কাজ হবে। এটা মনে রাখতে হবে, এখানে শিল্পীদের অভিনয়যোগ্যতার নির্বাচন হয়নি, হয়েছে ‘শিল্পী সমিতি’র নির্বাচন…

সভাপতি পদে ছিলেন মিশা-মৌসুমী৷ এই পদে বর্তমানে মিশার চেয়ে যোগ্য আর কেউ নেই। যদিও এটা শিল্পীদের ভোট, কিন্তু ২০০১ সাল থেকে নির্বাচনে ভোটারদের নিয়ে কাজ করতে করতে ভোটারদের মনস্তাতিক জগৎ নিয়ে আমার বেশ অভিজ্ঞতা অর্জন হয়েছে৷

ভোটাররা সাধারণত দুইটা বিষয় মাথায় রেখে ভোট দিয়ে থাকে। প্রথমত, কোন প্রার্থী তাদের কাছাকাছি ছিলো। দ্বিতীয়ত, প্রার্থীর প্রভাব আছে কতটা।

এই নির্বাচনে এ দুটো জিনিসেই মৌসুমীর চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন মিশা। গত নির্বাচনের পর থেকেই মৌসুমীর সাধারণ শিল্পীদের সাথে তেমন যোগাযোগ ছিলো না, কিন্তু মিশার ছিলো। সবার সাথে মিশার শুধু যোগাযোগই ছিলো না। তিনি তার সাধ্যমত সাধারণ শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। দ্বিতীয় যে বিষয়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো ‘প্রার্থীর প্রভাব’। বর্তমানে শাকিবের পরেই ইন্ডাস্ট্রিতে যার প্রভাব বেশি, তিনি হলেন মিশা সওদাগর।

ইন্ডাস্ট্রিতে নাকি ছবি হচ্ছে না। যে কয়টা ছবি হচ্ছে, তার অধিকাংশগুলোতেই মিশা আছেন। ‘মিশন এক্সট্রিম’ এর মত সিনেমাতে মিশা সওদাগরের যুক্ত থাকাটা আমার কথার প্রমাণ করে।

সেখানে গত দশ বছরে মৌসুমী’র না আছে কোনো ভালো সিনেমা, না সামনে আসছে নতুন কোনো সিনেমা !

ভোটাররা ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে এই প্রভাবের ব্যাপারটি খুব ব্যাপকভাবে মাথায় নিয়েই ভোট দেন। তাই মিশা সওদাগরের পাশ করাটাই যৌক্তিক এবং যথেষ্ট ন্যায় হয়েছে। মিশা পাশ না করলেই বরং সাধারণ শিল্পীরা তার সাথে অন্যায় করত…

মূলত, এই নির্বাচনে কোনোদিক দিয়েই মৌসুমীর পাশ করার কোনো কারণ ছিলো না। তবে মৌসুমী হয়ত আরও দশ-পনেরো ভোট বেশি পেতে পারতেন। সেটা সম্ভব হয়নি মিশা-জায়েদের নির্বাচনী ম্যাকানিজমের জন্য। যা কয়েকজন ভোটার মৌসুমীকে ভোট দিত, নির্বাচনের দুইদিন আগে মিশার প্যানেলের সব প্রার্থীদের ঘোষণা আসে, “মিশা পাশ না করলে, সবাই পদত্যাগ করবে”। এই ঘোষণা দু’মনা কিছু ভোটারকে মৌসুমীর দিক থেকে ফিরিয়ে এনেছে৷

এজন্য এই নির্বাচনে মিশা-জায়েদের জয়টা একদম স্বাভাবিকই ছিলো। এর জন্য ভোট কারচুপির কোনো দরকার ছিলো না। রাত দুইটায় ফলাফল দেয়া হয়েছেই ভোট গননাকে আরও স্বচ্ছ করতে। সিসিটিভি ক্যামেরায় মাঠে বসে সবাই ভোট গণনা দেখেছে।

বাংলা চলচ্চিত্র উন্নয়নে এই নির্বাচনের গুরুত্ব কতটুকু? এক ইঞ্চিও নেই৷ তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এই নির্বাচন নিয়ে এত মাতামাতি কেনো হলো? সেটা হলো বিনোদন। সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে সাংবাদিকেরা পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় এক ধরণের বিনোদন খুঁজে পেয়েছে। সেটা প্রার্থী দেখে এবং তাদের কয়েকদিনের কাজ-কর্ম এবং কথাবার্তাতে।

মূলত, এই নির্বাচন ছিলো- পূর্ণদৈর্ঘ্য কমেডি মুভি। দর্শকরা এজন্য এই নির্বাচন নামক মুভি নিয়ে এতো আগ্রহ দেখিয়েছে।

আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই নির্বাচনে রিয়াজ-ফেরদৌস-পূর্ণিমা-পপি’র স্বার্থের বলি হয়েছেন মৌসুমী। মৌসুমীকে মাঠে নামিয়ে পিছন থেকে সরে যাওয়াটা শুধু কাপুরুষের মত কাজ করেননি, বেইমানিও করেছেন। তারা বলেছেন, উপরের চাপে নির্বাচন করেননি। এটা ডাহা মিথ্যে কথা। গত নির্বাচনে এরা সরকারী দলের হয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন। রিয়াজ-ফেরদৌস প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। ডেঙ্গু নির্মূলের জন্য সরকারের মন্ত্রীদের সাথে এফডিসিতে ঝাড়ু নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছেন। তাই তাদের এই ‘উপরের চাপ’ কথাটা একদম মিথ্যা।

তারা মৌসুমীকে দিয়ে মিশার নাক কাটতে চেয়েছিলেন। আর আমার ধারণা এই বুদ্ধি রিয়াজের মাথা থেকেই এসেছে। কারণ গত নির্বাচনের পর রিয়াজ চেয়েছিলেন, সমিতিকে ব্যবহার করে শাকিব খানকে বিপদে ফেলতে। দুই বছর আগে শাকিব নিষিদ্ধের ঘোষণা শুনে পেছন থেকে রিয়াজের শাকিব বিরোধী সেই স্লোগান নিশ্চয় দর্শকেরা ভুলে যাননি। কিন্তু দেখা গেছে সমিতির সভাপতি মিশা শাকিবকে বিপদে না ফেলে একের পর এক শাকিবের সাথে সিনেমায় অভিনয় করে যাচ্ছেন। আর তাতেই মিশার প্রতি প্রতিশোধ নিতে মাঠে নামানো হয় মৌসুমীকে। তাতে যদি সে সফল নাও হয়, তবুও ব্যর্থ যেনো না হয়। তাই নির্বাচন থেকে সরে গিয়ে একা মৌসুমীকে বিপদে ঠেলে দিয়েছিলেন রিয়াজ এবং বাকিরা…

সাধারণ দর্শকরা এই সুচতুর বেইমানদের নিশ্চয় কোনোদিন ভুলে যাবে না? – (ব্যক্তিগত মতামত)

বিশ্বের অন্যসব ইন্ডাস্ট্রি বাদ দেন। আপাতত পাশের টালিগঞ্জের সাথে এফডিসির তুলনা করেন। টালিগঞ্জ যদি ‘ডি গ্রেডে’র হয়, তাহলে বিএফডিসি ডব্লিউ গ্রেডে’র বা আরও নিচেই। ওদের ইন্ডাস্ট্রির প্রযোজক থেকে শুরু করে প্রডাকশন বয়ের শিক্ষা, শিল্পের প্রতি অনুরাগ, ট্যালেন্ট, যোগ্যতা এফডিসির শিল্পীদের থেকে হাজার গুন উপরে।

ছোট একটা উদাহরণ দিই- নির্বাচনের আগে জীবিত অভিনেতাদের মধ্যে লিজেন্ড এমন এক অভিনেতার নির্বাচন নিয়ে একটা ইন্টারভিউ দেখলাম। মিশা-যায়েদ সম্পর্কে তিনি বললেন- “মিশা-যায়েদ সমিতির জন্য যা করেছে, এর আগে কেউই সেটা করেনি।” সবচেয়ে মজার যেটা বলেছেন- “ওরা (মিশা-যায়েদ) কুরবানির মাংস সবার বাসায় দিয়েছে, আমার বাসায়ও।”

এই নির্বাচনের সবচেয়ে দামী ভোটারের কাছে কুরাবানির মাংস পাওয়া যদি এতোটা গুরুত্ব রাখে, সেখানে সাধারণ ভোটারদের মানুসিকতা চিন্তা করেন।

এফডিসির বর্তমান শিল্পীদের কোনো প্রকার শিক্ষা এবং যোগ্যতা নেই৷ শিল্পীর বাইরে যদি তাদের সাধারণ মানুষ হিসাবে ধরেন, তাইলে যোগ্যতায় তারা সমাজের তৃতীয় শ্রেণির মানুষের-ও নিচেই থাকবে। এজন্য দেখবেন, সারাজীবন ইন্ডাস্ট্রিতে থেকেও শেষ বয়সে সবাই চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। কিংবা সরকারি অনুদানের উপর বেঁচে থাকে৷

এর কারণ আগেই বললাম- সাধারণ মানুষ হিসাবে তাদের যোগ্যতা সমাজের চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণির মানুষের মতো। এফডিসির বাইরে তাদের জগৎ শূন্য। এই মানুষরা যখন ভোটার তখন তাদের নেতা হবে কিরকম?

৫.

শাকিব খান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলেছেন- এই নির্বাচনে চলচ্চিত্রের কোনো লাভ নেই৷ এটা একটা উৎসব, এদিন সব শিল্পীরা একজায়গায় হয়ে আড্ডা-গল্প হয়।

শাকিবের কথায় বিশ্বাস করি৷ কাজ করতে হবে। সিনেমা বানাতে হবে। শুধু সমিতিতে বসে থাকলে, এই ইন্ডাস্ট্রির চার-আনা লাভ হবে না।

তাই বর্তমানের এফডিসির অবস্থা চিন্তা করলে, মিশা-যায়েদ-ই তাদের জন্য সবচেয়ে যোগ্য নেতা।