একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা ও জনমানুষের নেতা সাদেক হোসেন খোকা

বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা’র মৃত্যুতে আহমেদ মোস্তফা কামালের স্মৃতিচারণ মূলক লেখাটি ছারপোকা ম্যাগাজিনের পাঠকদের উদ্দেশ্যে শেয়ার করছি –

চেনা অচেনা সাদেক হোসেন খোকা

একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা, অখণ্ড ঢাকার শেষ নির্বাচিত মেয়র সাদেক হোসেন খোকা চলে গেলেন। আমাদের আগের প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের মধ্যে যাঁরা দল-মত নির্বিশেষে সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন, তিনি তাঁদের একজন।

অনেক কথা মনে পড়ছে। একটা বলি। ২০০৭-এর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার ঘটনা। রাজনীতিবিদরা তখন রীতিমতো দৌড়ের ওপর আছেন। সেনাবাহিনীর কল্যাণে রাজনীতিবিদদের নিয়ে নানা গল্পগাথা তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন। কিন্তু খোকা সাহেবকে ধরা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। কোনো খুঁতও পাওয়া যাচ্ছে না। তো, সেই সময় তাঁকে নিয়ে আসা হলো টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে। মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের উপস্থাপনায় সেই অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল ঢাকার যানজট নিরসনে সিটি কর্পোরেশনের ব্যর্থতার অনুসন্ধান। নানা প্রসঙ্গে কথা হলো, কিন্তু সবচেয়ে বেশি আলোচনা হলো শহরের রাস্তা থেকে রিকশা উঠিয়ে দেওয়া নিয়ে। সারা পৃথিবীর কোনো মেগাসিটিতে রিকশার মতো ধীর গতির বাহন নেই, ঢাকায় কেন থাকবে, কেন রিকশা উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে না, বারবার তাঁকে এই প্রশ্নে জর্জরিত করা হলো। অনেকক্ষণ তিনি ধৈর্য ধরে উত্তর দিচ্ছিলেন, কিন্তু উপস্থাপক মহোদয় বোধ-হয় পণ করেছিলেন, মেয়রের কাছ থেকে রিকশা তুলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় না করে ছাড়বেন না। একসময় মেয়র ক্ষেপে গেলেন। ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন : ঢাকা শহরে রিকশার সংখ্যা ছয় লাখের বেশি, দুই শিফটে সেগুলো চালায় বারো লাখ লোক, প্রতিটি চালকের আয়ের ওপর নির্ভরশীল অন্তত চারজন লোক, তার মানে আটচল্লিশ লাখ। আবার রিকশাকে কেন্দ্র করে অনেক জীবিকা তৈরি হয়েছে, যেমন রিকশা তৈরি করা, সারানো, যন্ত্রপাতি তৈরি ইত্যাদি। এইসব পেশার ওপর নির্ভরশীল আরো কয়েক লাখ লোক। আমি যদি আজকে রিকশা তুলে দেই, অন্তত সত্তর-আশি লাখ লোক মহাবিপদে পড়বে। আবার যারা রিকশায় চড়েন, তারাই বা যাবেন কোথায়? আমরা তো আপনাদের মতো সুশীল সমাজের বুদ্ধিজীবী নই, আমরা রাজনীতিবিদ, এসব কথা তো আমাদের ভাবতে হয়! আপনারা চাইলেই তো আমরা রিকশা তুলে দিতে পারি না।

এই বক্তব্যের পর উপস্থাপক আর কথা খুঁজে পেলেন না। ভ্যাবা-চ্যাকা খেয়ে প্রসঙ্গ পাল্টালেন।

বিরাজনীতিকরণের সেই ভয়ংকর জলপাই-সুশীল জামানায় একজন সাদেক হোসেন খোকা এভাবেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন রাজনীতিবিদদের ভূমিকা ও প্রয়োজনীয়তা।

ঢাকার অনেকগুলো রাস্তার নামকরণ তিনি করেছিলেন ভাষা সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা এবং বুদ্ধিজীবীদের নামে। এই প্রশ্নে তিনি দলমতের ঊর্ধ্বে উঠেছিলেন। তাঁদের নামাঙ্কিত সেইসব রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় এখনো তাঁকে মনে পড়ে।

তিনি দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন, পারেন নি। শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে, তাঁর কবরটি যেন বাংলাদেশের মাটিতে হয়। আশা করি, সরকার এই মহান মুক্তিযোদ্ধার শেষ ইচ্ছা পূরণ করবে। তাঁর মরদেহ ফিরিয়ে এনে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে দাফন করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা করতে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।

আপনাকে আমরা মনে রাখবো হে বীর যোদ্ধা, স্মরণ করবে আগামী প্রজন্মও। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন আপনার মতো মুক্তিযোদ্ধারা থাকবেন মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়।

আপনার অনন্ত জীবন শান্তিময় এবং মর্যাদাপূর্ণ হোক।