পানামার বিশ্বকাপ রূপকথা

১০ই অক্টোবর ২০১৭ দিনটি পানামার ফুটবল ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। এই দিনে দেশটির ফুটবল দল এমন কিছু অর্জন করে যা ঐ দিনটির পূর্বে একেইবারেই অসম্ভব হিসবেই ধরা হত। হ্যা , এই দিনে তারা তাদের ইতিহাসের প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়। প্রেসিডেন্ট হুয়ান কার্লোস সাথে সাথে সারা দেশে জাতীয় ছুটি ঘোষণা করেন, আনন্দ উৎসবে মেতে ফুটবল এক পাগল জাতি।

পানামা সাধারণত বিখ্যাত কলা উৎপাদন ও পানামা খালের জন্য। তাদের ফুটবলের ইতিহাসও অনেক পুরনো। ফুটবলে তাদের প্রথম সফলতা আসে ১৯৫১ সালের সেন্ট্রাল আমেরিকা এন্ড ক্যারিবিয়ান চ্যাম্পিয়নশীপ জয়ের মাধ্যমে। কিন্তু ১৯৭৪ এর আগে তারা কখনো বিশ্বকাপ বাছাইয়ে অংশ নিতে পারে নি। ১৯৭৪ এর বিশ্বকাপ বাছাইয়ে কনকাকাফ অঞ্চলের বাঘা বাঘা দলগুলোর কাছে বিদ্ধস্ত হয়ে তাদের বিশ্বকাপ স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। এরপর থেকে প্রায় প্রতিটি বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে তাদের ভাগ্যে একই গল্প লেখা ছিল। মাত্র ৩০ লাখ জনসংখ্যার একটা দেশের পক্ষে কিভাবে সম্ভব মেক্সিকো যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশকে পেছনে ফেলে বিশ্বকাপে জায়গা করে নেওয়া?

Panama vs Costa Rica match

বিংশ শতাব্দীতে পানামার ফুটবলের অবকাঠামো অত্যন্ত নিম্নমানের ছিল। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে হোসে হার্নান্দেজের হাত ধরে আসে আমূল পরিবর্তন।২০০৫ সালে কলম্বিয়ান এই কোচের অধীনে ১২ বছর পর গোল্ড কাপে অংশ নেই পানামা। গ্রুপ পর্বে দ্বিতীয় হয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পেনাল্টিতে দক্ষিন আফ্রিকাকে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করে সেমিফাইনালে জায়গা করে নেয় পানামা। চমক তখনো শেষ হয় নি। দক্ষিন আমেরিকার হেভিওয়েট কলম্বিয়াকে সেমিফাইনালে ৩-২ গোলে হারিয়ে সারা বিশ্বকে অবাক করে দেয় তারা। ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল লন্ডন ডনোভান , ক্লিন্ট ডেম্পসির যুক্তরাষ্ট্র। নিউজার্সির জায়ান্ট স্টেডিয়ামে অসাধারনভাবে লড়াই করে যুক্তরাষ্ট্রকে রুখে দেয় তারা। কিন্তু টাইব্রেকারে হেরে গিয়ে থেমে যায় তাদের রূপকথা। অসাধারন পারফর্মেন্সের সুবাদে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে পুরষ্কৃত হন পানামার জেইমি পেনেডো। ফুটবল মানচিত্রে নতুন এক দেশ পানামা জায়গা করে নেয় সেদিন।

হার্নান্দেজ চলে গেলেও পানামার উত্থান থেমে থাকেনি। ২০০৭ সালের কোপা সেন্ট্রাআমেরিকার ফাইনালে খেলে তারা। দূর্ভাগ্যজনকভাবে এবারেও ফাইনালে টাইব্রেকারে কোস্টারিকার কাছে হেরে যায় তারা। পরেরবার আবারও ২০০৯ সালের কোপা সেন্ট্রাআমেরিকার ফাইনালে যায় তারা সেমিফাইনালে হন্ডুরাসকে ১-০ গোলে হারিয়ে। আবারও প্রতিপক্ষ কোস্টারিকা এবং আবারও ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। কিন্তু এবার প্রস্তুত হয়েই এসেছিল তারা। এবার পানামার কোনো খেলোয়াড়ই পেনাল্টি মিস করে নি। দীর্ঘ অপেক্ষার পর তারা প্রথম শিরোপার স্বাদ পায়। ২০১৪ বিশ্বকাপের বাছাইয়ে ভাল শুরু করা সত্ত্বেও ফর্ম ধরে রাখতে পারে নি তারা। ভালভাবেই বাদ পড়ে যায় তারা।

নতুন কোচ ও নতুন আত্মবিশ্বাস নিয়ে ভাল করার প্রত্যয় নিয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপের ক্যাম্পেইন শুরু করে তারা। প্রথম ম্যাচে জ্যামাইকাকে হারিয়ে শুরু করলেও কোস্টারিকার কাছে হেরে যায় তারা এবং দুর্বল হাইতির বিপক্ষে হতাশাজনকভাবে ড্র করে তারা। পরবর্তী ছয় ম্যাচে অপরাজিত থেকে বিশ্বকাপের ধূসর স্বপ্নে চোখ রেখে ২০১৬ শেষ করে পানামা।কিন্তু পরের বছর পরপর ছয় ম্যাচে জয়হীন থেকে সেই স্বপ্ন ফিকে হয়ে যায়। ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগোকে ৩-০ গোলে হারানোর পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ০-৪ গোলে বিদ্ধস্ত হয়ে যায় তারা।

Panama qualify for world cup

Panama qualify for world cup (AFP/Getty Images)

বিশ্বকাপের স্বপ্ন নির্ধারণী শেষ ম্যাচে কোস্টারিকার মুখোমুখি হয় পানামা। সেই কোস্টারিকা যারা গত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে, যেই দলের গোলরক্ষক রিয়াল মাদ্রিদের সুপারস্টার কেইলর নাভাস। তার উপর আগের ম্যাচেই ০-৪ গোলে বিদ্ধস্ত হবার স্মৃতি।

খেলার একেবারে শেষ পর্যায়ে ১-১ গোলের সমতায় শেষ বাশির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ফলাফল এমনটা হলে বিশ্বকাপের টিকেট পেত হন্ডুরাস এবং প্লে অফের টিকেট পেত যুক্ত্ররাষ্ট্র যারা আশ্চর্যজনকভাবে ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগোর কাছে হেরে গিয়েছে।

তারপরেই আসে পানামার ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা মূহুর্ত। শেষ বাঁশি বাজার ঠিক ২ মিনিট আগে ডিবক্সের মধ্যে বল পেয়ে যান রোমান টোরেস যিনি দুর্দান্ত শটে গোলকিপারকে পরাস্ত করে বল জালে জড়ান। মেজর লীগে খেলা টোরেস পানামার নায়ক হয়ে উঠেন। শুরু হয় উৎসব। জাতীয় ছুটির ঘোষণা দেয়া হয়।রাস্তায় রাস্তায় শুরু হয় আনন্দ মিছিল। বিশ্ববাসী ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম বড় চমক উপহার পায়। মাত্র ৪০ লাখ জনসংখ্যার দেশ পানামা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে রাশিয়া বিশ্বকাপে জায়গা করে নেয়।

বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে পানামার প্রতিপক্ষ –

  • ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম এবং আলজেরিয়া

(প্লেয়ার্স টু ওয়াচ আউট ফর – জেইমি পেনেডো, গোলরক্ষক – ডায়নামো বুখারেস্ট, ব্লাস পেরেজ, স্ট্রাইকার – মিউনিসিপাল)

Leave a Reply