‘আর বেশি কাঁদালে উড়াল দেব আকাশে’ – উৎসব পার্বনে রাস্তার মোড়ে মোড়ে বেজে চলা এই গানের কথার মতই যেনো উাড়াল দিয়েছেন গানে ও গিটারে অন্যর হৃদপিণ্ডে কাঁপন তোলা আইয়ুব বাচ্চু। যিনি একাধারে গায়ক, লিড গিটারিস্ট, গীতিকার, সুরকার, প্লেব্যাক শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক। একটা প্রজন্ম মেতে ছিলো বাচ্চুর কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে। আইয়ুব বাচ্চুর সংসার, পরিচয়, সঙ্গীত জীবনের শুরু,শেষ,যাদের সাথে ঝামেলা, প্রথম যতকিছু, শেষ সবকিছু জেনে নেয়া যাক…
আইয়ুব বাচ্চু’র জন্ম, বেড়ে উঠা এবং শুরু
এই গুণী শিল্পীর জন্ম ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের চট্টগ্রাম শহরের। তার পারিবারিক ডাক নাম ছিল রবিন। পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন আইয়ুব বাচ্চু। সঙ্গীত চর্চার জন্য খুব একটা অনুকূল পরিবেশ যে তিনি পেয়েছিলেন তা কিন্তু নয়। সেই ছোটবেলা থেকেই সংসারে থেকেও বোহেমিয়ান রবিন। বাউন্ডুলে স্বভাবের জন্য সংসারের কিছুই যেন স্পর্শ করতে পারছিল না তাকে।
ঘরের সকলেই খুব ভালভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াইয়ে ব্যস্ত। কিন্তু রবিনের মন বলে অন্য কথা। তিনি ভাবতেন ছকে বাঁধা জীবন তার না। নয়টা-পাঁচটা চাকরি করার পেছনে ছোটার জন্য যেন জন্ম হয়নি তার। চলতেন নিজের সুর ধরে। এ কারণে পরিবারের থেকে গোল্লায় গেছেন শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গিয়েছিলো। পাত্তা দিতেন না। এরপর একদিন টিভিতে দেখা পান আজম খানের।
অনেক আগে থেকেই আজম খানের ভক্ত ছিলেন। মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন পপ সম্রাটের গান। পাশে ঝাঁকড়া চুলে বোতাম খোলা শার্টে একজন গিটার বাজাচ্ছেন অসাধারণ দক্ষতায়। সেই প্রথম পরিচয় গিটারে দক্ষ হাতের খেলা। হবেই না বা কেন? বাজাচ্ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম কিংবদন্তী গিটারিস্ট ‘নয়ন মুন্সি’। এই লোকটি বাংলাদেশের গিটার জগতে এক অনন্য নাম। সে সময়কার অনেক পরিচিত গান, যেমন- এই নীল মনিহার, মন শুধু মন ছুঁয়েছে, মেলায় যাই রে, আবার এলো যে সন্ধ্যা প্রভৃতি কালজয়ী গানের গিটারিস্ট তিনি। তার এই অনবদ্য বাজনা শুনে রবিন ঠিক করে ফেললেন, জীবনে আর কিছু চান না, শুধু এমন অসাধারণভাবে গিটার বাজাতে চান। সেই থেকেই গিটারের পিছে ছোটা, যা আজও শেষ হয়নি।
আইয়ুব বাচ্চুর সবচেয়ে জনপ্রিয় গান “চলো বদলে যাই”। গানটি ‘সেই তুমি’ নামেই অধিক জনপ্রিয়। এ গানটি আইয়ুব বাচ্চু তার প্রেমিকার (বর্তমান স্ত্রী) জন্য গেয়েছিলেন। এই গানটি বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে আজীবন। আইয়ুব বাচ্চুকে পছন্দ করেন না, এমন মানুষরাও এই গানটি শুনে একবারের জন্য হলেও অতীতে ফিরে যাবেন। কারণ এ গানের কথাগুলো রুপকথা থেকে আসেনি। এগুলো আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনের গল্প…
প্রথম যতকিছু
- সোলসে থাকার সময়ই ১৯৮৬ সালে তাঁর প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্তগোলাপ’ বের হয়।
- ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’ এটি তাঁর গাওয়া প্রথম চলচ্চিত্রের গান।
- ‘হারানো বিকেলের গল্প’ নামের গানে প্রথম কণ্ঠ দেন তিনি।
- টানা ৩০ মিনিট গিটার বাজিয়ে ৩০ টাকা প্রথম আয় করেন তিনি।
- ১৯৯০ সালের ৫ই এপ্রিল নিজের ব্যান্ড দল প্রতিষ্ঠা করলেন আইয়ুব বাচ্চু, যার নাম রাখলেন ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। পরবর্তীতে এর নাম বদলে রাখা হয় ‘লাভ রান্স ব্লাইন্ড’।
সংসার : ব্যক্তিগত জীবনে আইয়ুব বাচ্চু ফেরদৌস চন্দনাকে বিয়ে করেন। তাঁদের ঘরে জন্ম নেয় পুত্র ফাইরুজ ও কন্যা তাজওয়ার।
সঙ্গীত জীবনে যাদের সাথে ঝামেলায় জড়িয়েছেন
আইয়ুব বাচ্চুর শুরুটা ছিল আরেকজন গুণী গিটারিস্ট রুডি থমাসের হাত ধরে, যদিও গুরুমুখী বিদ্যার চাইতে স্ব-শিক্ষার্থীই ছিলেন বেশি। তবুও হাতে খড়িটা বেশ পোক্ত হাতেই হয়েছিল বলা চলে। কারণ রুডি থমাস ছিলেন তখন জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘সোলস’-এর অন্যতম সদস্য, আবার ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা। তার হাত ধরে ১৯৭৮ সালে ফিলিংসে যোগ দেন আইয়ুব বাচ্চু। ইংরেজি গানের কভার করার প্রবণতায় সেই সময় বেশি ছিল। প্রায় দু’বছরের মত কাজ করার পর ১৯৮০ সালের দিকে পারস্পরিক মনোমালিন্যে ভেঙে যায় ফিলিংস।
২০১৪ সালের ১৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ‘টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ২০১৪’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘বিসিবি সেলিব্রেশন কনসার্ট’-এ অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন নিয়ে মাইলস ব্যান্ডের হামিন-এর সাথে বাচ্চুর বিরোধ সৃষ্টি হয়। এই দ্বন্দ্বের সূত্রে বাচ্চু ও তার ব্যান্ড এল আর বি বাংলাদেশ ব্যান্ড মিউজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বামবা) সদস্যপদ প্রত্যাহার করে।
শেষ সময়ে…
২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে সকাল ৯টায় তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগে ‘শেকড়ের সন্ধানে’ নামে শেষ কনসার্ট করেছেন রংপুর জিলা স্কুল মাঠে ১৬ অক্টোবরে ২০১৮ সালে। ১৮ অক্টোবরে ২০১৮ সাল সকালে অসুস্থতার কারণে বাচ্চুর ব্যক্তিগত গাড়িচালক তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যায়। গাড়িতে তোলার সময় তার মুখ থেকে ফেনা বের হচ্ছিল। সকাল সোয়া নয়টার দিকে তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসকেরা জানান, হৃদ্ররোগে আক্রান্ত হয়ে বাচ্চুর মৃত্যু হয়েছে। কোটি মানুষের হৃদয় মাতানো একজন আইয়ুব বাচ্চু হার মানেন হৃদ্ররোগের কাছে…
শেষটা আইয়ুব বাচ্চুর সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি গানের দুই লাইন দিয়েই টানতে চাই –
“বুকেরই সব কষ্ট দু’হাতে সরিয়ে
চলো বদলে যাই…
তুমি কেনো বোঝনা তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়
আমার সবটুকু ভালবাসা তোমায় ঘিরে
আমার অপরাধ ছিল যতটুকু তোমার কাছে
তুমি ক্ষমা করে দিও আমায়…”