মানব সভ্যতা কোনো দূর্ঘটনা নয়, একটি পরিকল্পিত প্রক্রিয়া (পর্ব ১)

এই মহাবিশ্বের ছোট্ট একটি গ্রহে আমাদের অবস্থান। আমাদের এই গ্রহটির মত আরও আট দশটি গ্রহ মিলে সূর্য নামক একটি নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছি যাকে আমরা সোলার সিস্টেম বলি। সূর্যের মত এরকম আরও প্রায় বিশ হাজার কোটি (২০০০০০০০০০০০) নক্ষত্র মিলে আমরা থাকি মিল্কি ওয়ে (Milky Way Galaxy) নামের একটা গ্যালাক্সিতে !

এখন হয়ত আপনার চোখ বড় হয়ে যাচ্ছে গ্যালাক্সির দৈর্ঘ প্রস্থ বা ব্যাসের কথা ভেবে ! হ্যাঁ এই গ্যালাক্সির ব্যাস প্রায় এক লক্ষ আলোকবর্ষ। অর্থাৎ আপনি আমি যেই গ্যালাক্সিতে বসবাস করছি তার এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্তে আলোর গতিতে ছুটলেও পৌঁছাতে সময় লাগবে প্রায় এক লক্ষ বছর বা আনুমানিক তিন হাজার প্রজন্ম। আমরা তিন চার প্রজন্ম আগের কারো নাম ধামই মনে রাখতে পারি না, সেখানে তিন হাজার প্রজন্ম কত দীর্ঘ সময় ভাবুন ! তাও যদি আলোর গতিতে ছুটতে পাড়েন তবেই কেবল তা সম্ভব হবে ! নিশ্চয়ই জানেন, আলোর গতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার ! সহজে অনুমান করার জন্য আলোর গতির একটা উদাহরণ দেই। আপনি এক সেকেন্ডে সমস্ত পৃথিবী সাতবার প্রদক্ষিণ করতে পারবেন যদি একবার আলোর গতিতে ছুটতে পারেন ! কিছু বুঝা গেলো?

হ্যা‍ঁ আমাদের আবাসস্থল মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি এতটাই বড়, এতটাই গ্রহ নক্ষত্রে পরিপূর্ণ ! এখন যদি নিজের গ্যালাক্সি ছেড়ে পুরু মহাবিশ্বের একবার তাকান তাহলে হতভম্ব হয়ে দেখবেন আমাদের বিশ হাজার কোটি নক্ষত্র বিশিষ্ট গ্যালাক্সিটির মত আরও বারো হাজার কোটি (১২০০০০০০০০০০) গ্যালাক্সি রয়েছে মহাবিশ্বে ! এখন বিশ হাজার কোটির সাথে বারো হাজার কোটি গুণন করে দেখুন মহাবিশ্বে কত তারকা রয়েছে। তাহলে বুঝবেন ফেসবুক তারকার সংখ্যা বেশি নাকি মহাবিশ্বের… ?

তারপর উক্ত তারকা সংখ্যার সাথে গড়ে দশটি করে গ্রহ গুণন দিয়ে বের করে নিন এই মহাবিশ্বে পৃথিবীতুল্য আনুমানিক গ্রহের সংখ্যা ! আপনি অচিরেই বুঝে যাবেন একেকটি স্বর্গবাসীর জন্য ঈশ্বরের কথা অনুযায়ী দশটি করে পৃথিবী এই মহাজগতে রয়েছে নাকি নাই ! দেখবেন প্রয়োজনের চেয়ে কয়েক শতগুণ অধিক রয়েছে…

হ্যাঁ ঈশ্বর ! আমার ইউনিভার্স এন্ড মাল্টিভার্স সম্পর্কিত সামান্য জ্ঞান বলে এই মহাজগৎ অত্যন্ত নিপুণ হাতের সৃষ্টি, এবং এই পৃথিবী ও তার বুকে মানব সভ্যতার বিকাশ অত্যান্ত প্ল্যানড এন্ড প্রিডিটারমান্ড ! হোক তা ঈশ্বর আল্লাহ ভগবান, সে যেই হোক, তবে একজন সেখানে রয়েছে তা হলফ করে বলে দেয়া যায়। আসুন, গল্পের সাথে থাকুন, গল্পে গল্পে যদি কিছুটা খোদার নাগাল পাওয়া যায় কিনা দেখি !

ঈশ্বরের উপস্থিতি : Existence of God

অনেকেই ভাবেন, পৃথিবীতে মানবসভ্যতা একটি দূর্ঘটনা কেবল, এর পেছনে কারও পরিকল্পনা নেই।

আমরা দূর্ঘটনা বা আকস্মিক ঘটনা কাকে বলি? একটি ঘটনা যা ঘটার নয় কিন্তু হুট করেই ঘটে গেলো, আমরা বলি আকস্মিক ঘটনা। কিন্তু যদি তা একটি ঘটনা না হয় ! ধরুন পরপর দুইটি আকস্মিক ঘটনা দিয়ে একটি ঘটনা ঘটে গেলো, তখন কি বলবেন? আপনারা বলবেন, এটা কিছুটা অলৌকিক ! একজন নাস্তিক বলবেন, এটা রহস্যময় ! দুটি বা তিনটি সিরিজ ঘটনার বদৌলতে কোন আকস্মিক ফলাফল ঘটলেই যাদের কাছে তা রহস্যময় লেগে যায়, তাদের কাছ থেকে শত শত রহস্যময় আকস্মিকতার ভিতর দিয়ে জন্ম নেয়া আজকের মানব সভ্যতার বিকাশের কোন যৌক্তিক কারন শুনতে পাবো নিশ্চয়ই আশা করাটাও ভুল। তাদের কাছে এটার জন্য রয়েছে সুন্দর নাম “দূর্ঘটনা” !

কিন্তু সেই দূর্ঘটনা কতগুলো? আসুন শুধুমাত্র উল্লেখযোগ্য কিছু দূর্ঘটনা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করে দেখি আদৌ সেগুলোকে দূর্ঘটনার নাম দেয়া যায় কিনা নাকি মহা পরিকল্পনা ! একচ্যুয়ালি গড এক্সিস্টস অর নট! এযাবৎ আবিষ্কৃত মহাবিশ্ব আমাদের কি বলে?

বিগ ব্যাং এর প্রায় ৯০০ কোটি বছর পর অর্থাৎ আজ থেকে আনুমানিক ৫০০ কোটি বছর পূর্বে আমাদের এই সৌরমন্ডল বা সোলার সিস্টেমের সৃষ্টির সূত্রপাত ঘটে। সেসময় মহাশূন্যে আমাদের সৌরমন্ডলের স্থানে ছিল ইন্টার্স্টেলার গ্যাস, সুপার আয়োনাইজড প্লাজমা, হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও ধূলো মিলে মেঘের ন্যায় একটি ভেলা। যাকে আমরা সায়েন্সের ভাষায় নেবুলা বা নিহারিকা বলি।

ধীরে ধীরে সেই মেঘের প্রায় ৯৯.৯ শতাংশ পুঞ্জিভূত হয়ে সূর্য্যের সৃষ্টি করে। বাকি দশমিক এক শতাংশ গ্যাস আর ধূলোকণা হাল্কা অবস্থায় সূর্য্যের চারদিকে একটি ডিস্কের ন্যায় প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে যাকে প্রোটো প্লানেটরি ডিস্ক বলে। সেই প্রোটো প্লানেটরি ডিস্কের ভিতর বিভিন্ন দূরত্বে বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে অন্যান্য গ্রহ, উপগ্রহ সহ আমাদের এই পৃথিবীর সৃষ্টি।

এটা গেলো অন্যান্য কোটি কোটি গ্রহ নক্ষত্রের ন্যায় আমাদের পৃথিবীর সৃষ্টির গল্প। এতটুকু পর্যন্ত খুব স্বাভাবিক, কোটি কোটি প্লানেটরি সিস্টেমের জন্মের রহস্য একই। এভাবেই ১৪০০ কোটি বছর পূর্বে বিগ ব্যাং ঘটার পর থেকে থোকায় থোকায় ঘুরে বেড়ানো আয়োনাইজড মেঘের ভেলা বা নেব্যুলা থেকে সুপার কম্পোজড হয়ে কোটি কোটি প্লানেটরি সিস্টেমের সৃষ্টি !

… কিন্তু মানব সভ্যতা?

মানব সভ্যতা কোটি কোটি প্লানেটে সৃষ্টি হয় নাই ! কি ঘটেছিল তাহলে আমাদের প্লানেটের সাথে যে আজ আমরা এখানে নি:শ্বাস ফেলি, স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন বাঁধি !

প্রায় সাড়ে চারশো কোটি বছর পূর্বে পৃথিবী আজকের চেয়ে অনেক বেশী সূর্য্যের নিকটবর্তী ছিল। যেখানে সূর্য্যের তাপমাত্রা হয়ত ২০০ থেকে ৩০০ ডিগ্রী বা তার আশেপাশে ছিল! যেই তাপমাত্রায় জীবের অস্তিত্ব তো দূর পানির অস্তিত্বও তরল অবস্থায় অকল্পনীয় ছিল! আর আমরা জানি, পানি ব্যাতীত জীবের অস্তিত্ব অসম্ভব! সুতরাং এই গ্রহে মানব সভ্যতার প্রথম শর্ত ছিল গ্রহটিকে সূর্য্য হতে নির্দিষ্ট দূরত্বে চলে যেতে হত। কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব? ভর, আকার, আয়তন এবং মহাকর্ষ ও অভিকর্ষ মিলিয়ে পৃথিবীতো ততদিনে নিজের কক্ষপথ বেছে নিয়েছিল! তাকে দূরে সড়াবে কে?

পৃথিবী সৃষ্টির প্রায় পঞ্চাশ কোটি বছর পর আনুমানিক মঙ্গল গ্রহের সমতুল্য ‘থিয়া’ নামক একটি গ্রহাণু পৃথিবীর বুকে আছড়ে পরে! পৃথিবী চলে আসে আজকের অরবিটে যেখানে সূর্য্যের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পানির পক্ষে তরল অবস্থায় বিরাজ করা সম্ভব! এই জোনকে গোল্ডি লক্স জোন বা হেভিটেবল জোন বলা হয়। এই জোনের আগে অবস্থান করা কোন গ্রহে পানি বাষ্পায়িত রূপে বিরাজ করবে, পেছনে পানি বিরাজ করবে কঠিন বা বরফ রূপে!

অর্থাৎ বলা যায়, সৌরমন্ডলের এই গোল্ডি লক্স জোনে পৃথিবীর চলে আসার ঘটনাটি আজকের মানব সভ্যতার সূত্রপাতের প্রথম শর্ত পূরণ করে।

দ্বিতীয় শর্ত পূরণ করে মায়াবী চাঁদ!

প্রায় চারশো কোটি বছর আগে গ্রহাণুর সাথে বিকট সংঘর্ষের কারনে পৃথিবীর বুক চিড়ে তার ছয় ভাগের একাংশ নিয়ে বেড়িয়ে যায় মায়াবী চাঁদটি! তার পূর্বে চাঁদ পৃথিবীরই অংশ ছিল। সুনিপুণ পরিকল্পনায় সেদিন চাঁদের সৃষ্টি না হলে আজ আমরা এখানে থাকতাম না! এই পৃথিবী হত প্রাণহীন অন্যান্য ভূখন্ডের মত। চাঁদ কেবল রূপকথার গল্পের খোরাক নয়, মানব সভ্যতারও বিরাট খোরাক!

চাঁদ এই পৃথিবীতে দুইভাবে জীব-বিকাশে সহায়তা করেছে। এই দুইটির কোনটি ছাড়াই পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব অসম্ভব ছিল।

চাঁদ ছাড়া পৃথিবীর বুকে পিরিয়ডিক ওয়েদার সৃষ্টি হত না। জীবন স্থিরতা পছন্দ করে। বর্তমান পৃথিবীর বুকে যে সুনির্দিষ্ট সময়ে সামার ও উইন্টারের আগমন ঘটে তা এই চাদের কারনেই। নয়ত পৃথিবীর উত্তপ্ত স্থান উত্তপ্তই হতে থাকত আর শীতল স্থান হতে থাকতো ক্রমাগত শীতল! অন্যান্য গ্রহের ক্ষেত্রে যা হচ্ছে! কারন তাদের কাছে চাঁদের মত কর্তৃত্ব খাটানো সুবিশাল উপগ্রহ নেই!

ঐ সুন্দর চাঁদটা না হলে পৃথিবীর বুকে আরও কিছু স্থিরতা অসম্ভব ছিল। যেমন পৃথিবীর আহ্নিক গতি। পৃথিবীর নর্থপোল সর্বদাই নর্থের দিকে থাকত না, সাউথপোল থাকত না সাউথের দিকে। পৃথিবীর চতুর্পার্শ্বের আয়তন ও ওজন সমান নয়। আপনি যদি একটি অসম ওজনের গোলক যেমন ধরুন একপাশে তামার পরিমান বেশি অন্যপাশে লোহার পরিমান বেশি এমন একটি গোলককে আঙ্গুলের মাথায় ঘুড়াতে চেষ্টা করেন সেটা ফুটবলের ন্যায় সুষমভাবে ঘুড়তে থাকবে না, হেলেদুলে ঘুড়বে। কারন গোলকটির দুই পাশের ভর দুইরকম! পৃথিবীরও তাই হত এবং এর ফলাফল সরূপ নিয়ত সমুদ্রের পানি সুনামির মত বিশাল ঢেউ মিয়ে আপনার ঘরে চলে আসত! উচু উচু ইমারতগুলো দাঁড়িয়ে থাকত না! ভূকম্পন হত প্রতিনিয়ত! অন্যান্য গ্রহে তাই হচ্ছে!

দূর্ঘটনা থেকে পৃথিবীর বুক চিড়ে চাঁদ এমন একটি আয়তন নিয়ে বেড়িয়ে গেছে যে আজকের পৃথিবীকে সে দোদুল্যমান হওয়া থেকে বাচিয়ে রাখছে নিজ অভিকর্ষজ বল দিয়ে নিয়ত ! উপগ্রহ অন্যান্য গ্রহেরও রয়েছে। কিন্তু তাদের আকার ও আয়তন অতোটা যথেষ্ট নয় যে তাদের গ্রহের উপর নিজেরা ড্যাম্পিং হিসেবে কাজ করতে পারে! অন্য কোন গ্রহের আহ্নিকগতি তাই সুষম নয়! হেলে দুলে তারা ঘুড়ছে আর দুলছে! যেই পরিস্থিতে জীবন অসম্ভব!

তৃতীয় আকস্মিক ঘটনাটি ঘটেছে ‘দ্যা লেট হেভি বোম্বার্টস’। এই ঘটনার মাধ্যমেই আজ থেকে প্রায় ৩৯০ কোটি বছর পূর্বে হঠাত সোলার সিস্টেমের কিছু পরিবর্তনের কারনে পৃথিবীর বুকে প্রচন্ড উল্কাপাতের ঘটনা ঘটতে থাকে! সেই উল্কাপাতের ভিতরে করেই পৃথিবীর বুকে প্রথম হিমায়িত পানির ক্রিস্টাল এর আবির্ভাব হয়, সাথে নাইট্রোজেন, প্রোটিন এবং এমোনিয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সমূহও চলে আসে এই পৃথিবীর বুকে! যা ছাড়া জীবের ফুড চেইন কল্পনা করা অসম্ভব! আজকের সাগর বা মহাসাগরের সমস্ত পানি সেই কয়েক কোটি বছরের উল্কাপাতের ফসল! এগুলো পরিকল্পিত বিষয়। এগুলো অন্যান্য গ্রহের সাথে ঘটেনি।

আমরা এই পৃথিবীতে এসে এসে চলে যাচ্ছি কিন্তু এটা না জানলে কিভাবে হবে যে কতোটা পরিকল্পনায় আমাদের এই নিরাপদ আবাসস্থল তৈরী!! কার পরিকল্পনায় তৈরি! কে সে? কারও পরিকল্পনা ছাড়া এতগুলো ক্রমান্বয় দূর্ঘটনা কি আদৌ সম্ভব?

এখনো পৃথিবীতে ম্যাংগানিজ, আয়রন, সালফারের মত জীবদেহের প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহের আবির্ভাব ঘটেনি।

বাকি রয়ে গেছে আরও কিছু দূর্ঘটনার গল্প যা আজকের মানব সভ্যতার পেছনে মৌলিক ভূমিকা রেখে গেছে ! যার একটিও না ঘটলে আজকে মানব সভ্যতা সৃষ্টিই হত না ! রয়ে গেছে সুপারনোভার প্রভাব, ওজন লেয়ারের সৃষ্টি, ম্যাগনেটিক বলয় ও ডায়নাসোরের মত দানবের বিলুপ্তি, যেগুলো ছাড়া মানব জন্ম অসম্ভব ছিল এই ধরণীতে। আপনাদের উতসাহ পেলে দ্বিতীয় পর্বে বাকিটুকু নিয়ে অচিরেই আসবো।