শীর্ষ সন্ত্রাসী কামাল পাশা ও তার ফিল্মি স্টাইলের খুনের ঘটনাগুলো

খুব সকাল সকাল রিভেলদের বাসার সামনে এসে দাঁড়ায় আনুমানিক ২৭-২৮ বছর বয়সী এক যুবক। মাথায় এলোমেলো চুল। পরনে জিন্স প্যান্ট আর প্রিন্টের শার্ট। চিৎকার করে রিভেলকে ডাকছিলো সে। এত সকালে কে ডাকাডাকি করছে, তা দেখার জন্য রিভেলের মা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান। তিনি যুবকটিকে বলেন, রিভেল ঘুমিয়ে আছে। বিনয়ের সঙ্গে যুবকটি তখন বললো, খালাম্মা রিভেলকে খুব দরকার। যুবকটি চেনাজানা বলেই মা রিভেলকে ডেকে দেন। রিভেল ঘুম থেকে উঠে বাসার বাইরে গিয়ে যুবকটির সঙ্গে দেখা করে। দুজনে কথা বলতে বলতে সামনের দিকে চলে যায়। কিছুদূর যাওয়ার পর একটি নীরব স্থানে গিয়ে যুবকটি তার পকেট থেকে পিস্তল বের করেন। রিভেল কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে দেন। গুলি রিভেলকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে যায়। রক্তাক্ত রিভেল নর্দমায় পড়ে থাকে। আশপাশের লোকজন জড়ো হবার আগেই যুবকটি ওই স্থান থেকে সরে যায়। এর প্রায় আধাঘণ্টা পর ওই যুবকটি আবারও ফিরে আসে রিভেলদের বাসায়। এবার রিভেলের বড় ভাই জুয়েলকে প্রয়োজন। একইভাবে জুয়েলকে ডাকতে থাকে সে। জুয়েল বেরিয়ে আসে। কথা বলতে বলতে তারা দুজনে এগিয়ে যায় সামনের একটি রাস্তার ধারে। যুবকটি এবার আর কোনো নীরব স্থান খুঁজেনি। রাস্তার ওপরই জুয়েলের শরীরে পিস্তল ঠেকিয়ে পরপর কয়েক রাউন্ড গুলি চালায়। রক্তাক্ত জুয়েল পড়ে থাকে রাস্তায়। হাতে ধরা পিস্তল উঁচু করে এবার দৌড়ে পালায় রহস্যময় সেই যুবকটি !

২০০০ সালের ৫ মে’র ঘটনা এটি। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে এভাবেই আধাঘণ্টার ব্যবধানে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে এক যুবক ফিল্মি স্টাইলে দুই ভাইকে গুলি করে হত্যা করেন। একজন মাত্র খুনি ঠাণ্ডা মাথায় পরপর দুটি খুন করে পালিয়ে যাওয়ার মত ঘটনা পুলিশের কেস হিস্ট্রিতেও বিরল। আর ঠাণ্ডা মাথার এই খুনি হলেন রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী কামাল পাশা। পলাতক থাকা অবস্থায় যার মাথার মূল্য সরকার লাখ টাকা ঘোষণা করেছিলো। বর্তমানে দুর্ধর্ষ এই সন্ত্রাসী কারাগারে আটক রয়েছেন। একের পর এক ফিল্মি স্টাইলে খুনের ঘটনা ঘটালেও তার পরিবার প্রথম থেকেই দাবী করে আসছিলো, তাদের সন্তান নাকি মানসিক প্রতিবন্ধী। মানসিক সমস্যার কারণে কামাল পাশাকে চিকিৎসাও করানো হয়েছিলো। পরিবারের এই দাবীর পর থেকে কামাল পাশা আন্ডারওয়ার্ল্ডে ‘পাগলা পাশা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কামাল পাশা দিনের বেলায় খুন করতে পছন্দ করতেন। তিনি তার সহযোগীদের প্রায়ই বলতেন, দিনে নানা কায়দায় আক্রমণ করা যায়। প্রতিপক্ষের মৃত্যু নিজের চোখে দেখা যায়। এতে করে মনে শান্তি পাওয়া যায়। কামাল পাশার ঘনিষ্ঠ ছিলেন এমন একজন জানান, অন্ধকারকে ভয় পেতেন কামাল পাশা। যে কারণে দিনের বেলায় খুনের ঘটনা ঘটাতেন।

যে হত্যাকাণ্ডগুলো কামাল পাশা ঘটিয়েছে, তার প্রত্যেকটিই ছিলো দুঃসাহসিক। ফিল্মি স্টাইলে খুন করতে ভালোবাসতো সে। তাকে দিয়ে রাজধানীর অন্যান্য শীর্ষ সন্ত্রাসীরা খুন করাতো। তার বিরুদ্ধে যে খুনের অভিযোগ রয়েছে, তার অধিকাংশগুলোতেই ভাড়াটে কিলার হিসেবে কাজ করেছে পাশা। ইতিমধ্যে দুটি খুনের ঘটনায় ফাঁসির রায় ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা থেকে জানা যায়, ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে আগারগাঁওয়ে খুন হন শামিম ও মামুন। শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ এই জোড়া খুনের ঘটনাটি ঘটায়। কিন্তু কিলার হিসেবে ছিলো কামাল পাশা। মূলত কামাল পাশার নেতৃত্বেই ওই জোড়া খুনের ঘটনাটি ঘটে। এই শামীম-মামুন জোড়া খুনের মধ্য দিয়েই হয় তার খুনাখুনির হাতে খড়ি…

১৯৯৭ সালের ২২ মে কামাল পাশা শাহবাগ পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) গুলি করে হত্যা করে ঠিকাদার আশিক ইকবাল -কে। দিনদুপুরে কামাল পাশা এবং তার সহযোগী রাশেদ মোস্তফা ওরফে রতনকে নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। আশিক ইকবালকে গুলি করে হত্যার পর তারা দুজনে একটি বেবি ট্যাক্সি নিয়ে পালাতে থাকে। শত শত লোকের সামনে পিস্তল উঁচিয়ে ধরে রাখে কামাল পাশা। বেবি ট্যাক্সিতে ওঠার পরেও তার হাতে পিস্তল শোভা পাচ্ছিলো। সোনারগাঁও হোটেলের সামনে একজন সার্জেন্ট পুলিশ জীবনবাজি রেখে তাদের সেই বেবি ট্যাক্সির গতিরোধ করে। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় তাদের দুজনকে পাকড়াও করা হয়। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় ২টি পিস্তল ও ২০ রাউন্ড গুলি। আটক কামাল পাশা জামিনে বেরিয়ে আসে।

এরপর ২০০০ সালের প্রথম দিকে কামাল পাশা উত্তরায় গুলি করে এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। এর কিছুদিন পরই বাসা থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে সেই দুই ভাই আশরাফ হোসেন জুয়েল (২৮) এবং মোহামদ আলী রিভেল (২৪) -কে। ঘটনা ঘটিয়ে কামাল পাশা গা ঢাকা দেয়। ওই অবস্থ‍ায়ই বনানীতে একজন ব্যবসায়ীকে হত্যা করে কামাল পাশা। বিএনপি জোট সরকার আমলে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশ করে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এরমধ্যে কামাল পাশাও নাম ছিলো। সেসময় তাকে ধরিয়ে দিতে এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। পরে কামাল পাশার বাবা তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয় ! এভাবেই একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যায় জগতের পথচলা স্থগিত হয়।