‘বেলা চাও’ গৃহযুদ্ধের সময় সৃষ্টি হওয়া সেই গান

Una mattina mi sono alzato
O bella ciao, bella ciao

নেটফ্লিক্স সিরিজ লাভারদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত একটি গানের লাইন । ২০১৭ সালে La Casa De Papel  নামের সিরিজটি যখন নেটফ্লিক্স এ প্রকাশিত হয় , সে সময়ই আলোচনায় আসে গানটি।  এটি কি শুধুই একটি গান , এর ইতিহাস প্রচলিত ১০ গান থেকে অনেক অনেক আলাদা।  এই গানের  সাথেই মিশে আছে সংগ্রাম , স্বাধীনতা, বিক্ষোভ , পরিশ্রম ও ভালবাসার অদ্ভুত মিশ্রন।

bella Ciao ইংরেজি আবিধানিক অর্থ করলে দাঁড়ায় Goodbye Beautiful  অথবা Goodbye Dear অর্থাৎ বাংলায় বিদায় সুন্দরী অথবা বিদায় প্রিয়। এটি মূলত হচ্ছে একটি ইতালীয় লোক সঙ্গীত। ১৯৪৩ এবং ১৯৪৫ সালে ফ্যাসিবাদী ইতালীয় সামাজিক প্রজাতন্ত্র এবং জার্মান নাজিদের  বিরুদ্ধে ইতালীর পক্ষবাদীরা তাদের সংগ্রামের সময় গানটি ব্যাবহার করে । এসময় সংঘবদ্ধ সশস্ত্র আন্দোলন পরিচিত হয় পার্টিজান আন্দোলন নামে। এই পার্টিজানদের মধ্যেই বেলা চাও গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাই কিছুটা রুপান্তরিত গানের একটি অংশেও যুক্ত হয়ে আছে পার্টিজানের গল্প

“এ সেইউ মুইও দা পার্তিজানো, ও বেলা চাও, বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও!”

“হে পার্টিজান, আমাকে নিয়ে যাও, … বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও … (বিদায় হে সুন্দরী)”

গানটির হৃদয়স্পর্শী লিরিকের জন্যই এটি হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের গান, ভালোবাসার গান। গানের একটি অংশে কোন এক প্রতিবাদী আন্দোলনরত কর্মীর মৃত্যুর পূর্বের শেষ আকুতির কথা ছিলো, যেখানে শত্রুবেষ্টিত অবস্থায় সে তার বন্ধুদের কাছে অনুরোধ করছে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, অথবা সে যদি মারা যায়, তাহলে তাকে পাহাড়ের উপর কবর দিয়ে একটি ফুল দিয়ে ছেয়ে দেওয়ার জন্য।  গানের ভাষায় সেটি ছিল

“সেপেলিরাই লাসুইন মোন্তাইনা,…ও বেলা চাও, বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও!
সেপেলিরাই লাসুইন মোন্তাইনা,সোতো লোমব্রা দি উন বেল ফিওর।”

“আমাকে কবর দিও ঐ পাহাড়ের উপর,… বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও … (বিদায় হে সুন্দরী)!
আমাকে কবর দিও ঐ পাহাড়ের উপর, কবরটি ছেয়ে দিও সুন্দর একটি ফুল দিয়ে।”

সেই সময়কার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চরম প্রভাব ফেলা এই গানটির সূত্রপাত দেখতে হলে আরো পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় অর্ধশত বছর আগে, যখন ইতালীর উত্তরাঞ্চলের কৃষি আবাদ ছিল ধান কেন্দ্রিক। ধানক্ষেতের শ্রমিকদের তখন কঠোর পরিশ্রম করানো হতো। স্বল্প মজুরী , অধিক পরিশ্রম ও অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে সেখানের নারী শ্রমিকরা বিদ্রোহী গান তৈরী করে, সম্মিলিত ভাবে তারা গাইতো

সিসার পাদরুন দাঁ লি বেলি ব্রাগি বিয়ান্সি”

যার কথা প্রচলিত ‘বেলা চাও’ থেকে আলাদা হলেও সূর ছিলো সম্পূর্ন এক। আর সবচেয়ে বড় মিল ছিল ‘বেলা চাও’ শব্দটি । অর্থগত মিল থাকলেও ভাবগত দিক থেকে  বেলা চাও কিন্তু আলাদা। ইতালীর আন্দোলনে পার্টিজানের সেই গানে বেলা চাও এর বেলা কিন্তু কোন সুন্দরী মেয়ে বোঝানো হয়নি। এখানের বেলা হচ্ছে প্রিয় মাতৃভূমি, অপরদিকে উত্তরাঞ্চলের কৃষিভূমিতে গাওয়া বেলা চাও এর বেলা বলতে কিশানীর সৌন্দর্যকেই বোঝানো হয়েছে।

বেলা চাও গানটির সবচেয়ে পুরাতন সংস্করনটি  ১৯০৬ সালের ইতালির ভার্সেল্লি থেকে এসেছে, তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়ই । অন্যান্য লোক সঙ্গীতের মত এরও গীতিকার সবারই অজানা। ইতালির প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সৃষ্ট গানটি  ১৯৪৩ এ এসে নতুন রূপ পায়। যা বিশ্বের মানুষের কাছে  ২০১৭ সালে এসে নতুন মাত্রা পায় ।

অসংখ্য শিল্পী গানটি রেকর্ড করেন। সবচেয়ে জনপ্রিয় রেকর্ডিং গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ইতালীয় লোক সঙ্গীত শিল্পী গিয়ভানা ডাফফিনির সংস্করণ, যিনি মন্ডিয়ানা এবং পার্তেসীয় উভয় সংস্করণ রেকর্ড করে ছিলেন। আর বর্তমানে এই গানের কথা বললেই সবার কল্পনায় ভেসে ওঠে  ‘  লা কাসা দে পাপেল ‘ এর প্রথম সিজনের শেষ পর্বে  প্রফেসর আর বার্লিন নামের দুই চরিত্র, রাতে ডাইনিং টেবিলে হাতে ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে যে গানটি গায় সেই দৃশ্যটি। গানের কথা গুলো কিন্তু চমৎকার যার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়

এটা হচ্ছে সেই পার্টিজানের ফুল,
বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও … (বিদায় হে সুন্দরী)!
এটা হচ্ছে সেই পার্টিজানের ফুল,
যে মারা গিয়েছিল স্বাধীনতার জন্য!