প্যানডেমিক ড্রিমস : করোনা দুর্যোগে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখার কারণ

করোনাভাইরাস সংক্রমণে দুনিয়াজুড়ে ৭০০ কোটি মানুষ গৃহবন্দি জীবনযাপন করছে। এমন ঘটনা গত ১০০ বছরে আগে কখনো ঘটেনি। এখন বেঁচে থাকার প্রধান উপায়ই একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা। এভাবে বাঁচতে গিয়ে মানুষ হারিয়েছে তার স্বাভাবিক জীবন। ঘুমের মাঝে  অনেকেই জেগে উঠছে স্বপ্ন দেখে। যা তা স্বপ্ন না। অদ্ভুত অদ্ভুত সব দুঃস্বপ্ন। বিষয়টা খেয়াল করেছেন কি? কেনো এমন ঘটছে, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট গবেষকরা। তাদের মতে, সামাজিক দূরত্ব মানুষের সব প্রেরণাকে কেড়ে নিচ্ছে, তাই স্বপ্নে হানা দিচ্ছে দুঃস্বপ্ন। আর এ দুঃস্বপ্ন শুধু আপনিই দেখছেন না, দেখছে পৃথিবীর অর্ধ শতাংশ মানুষ !

প্যানডেমিক ড্রিমস

গ্লোবাল প্যানডেমিকের সময় দুঃস্বপ্ন দেখার কারণ নিয়ে রিসার্চ করতে বসে জানলাম, বিখ্যাত ‘ওয়াইল্ডার’ উপন্যাসের লেখক ল্যান্স ওয়েলার সম্প্রতি অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি দেখেছেন, মৃত প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান প্রটোকল সহ একটা কালো গাড়িতে করে তার পাশে এসে হাজির ! গাড়ির কাচ নামিয়ে তিনি ওয়েলারকে গাড়িতে উঠতে বলেন। তারপর প্রেসিডেন্ট রিগ্যান লেখক ওয়েলারকে নিয়ে একটা কমিক বইয়ের দোকানে গেলেন। ওয়েলার দেখলেন, সেখানে তার পছন্দের সব কমিক বই তাকে তাকে সাজানো। কিন্তু বই কেনার আগে হঠাৎই ওয়েলারের মানিব্যাগ নিয়ে প্রেসিডেন্ট রিগ্যান কেটে পড়লেন ! একজন প্রেসিডেন্ট চুরি করেছে তার মানিব্যাগ !

সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গত পাঁচমাস যাবৎ দুনিয়ার নানা প্রান্তের মানুষ এমন অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন, যাকে সহজ ভাষায় বলা যায় নভেল করোনাভাইরাস প্যানডেমিক ড্রিমস ! যদিও বিজ্ঞান দীর্ঘদিন যাবৎই বলে আসছে, স্বপ্নের বিষয়বস্তু ও অনুভূতি আমাদের জেগে থাকা সময়ের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। ইঙ্গিতপূর্ণ অদ্ভুত স্বপ্নগুলো কাউকে কাউকে তাদের তীব্র স্মৃতি ও দৈনন্দিন মানসিক চাপ থেকে অবচেতনে মুক্তি দিয়ে থাকে। আর এর বিপরীতে দুঃস্বপ্ন হচ্ছে উদ্বিগ্নতার সতর্ক বার্তা, যা কিনা সম্ভবত আমরা আমাদের জেগে থাকা অবস্থায় অনুভব করতে পারি না।

করোনাভাইরাসের এ মহামারীকালে কোটি কোটি মানুষ গৃহবন্দি অবস্থায় আছে। এসময় এত বেশি পরিমাণে দুঃস্বপ্ন দেখার বিষয়টি সম্পর্কে স্বপ্নবিশারদরা মনে করছেন, নিজেদের পরিচিত পরিবেশে থাকতে না পারা এবং দৈনন্দিন জীবনের থমকে যাওয়া উদ্দীপনা অনেককে একধরনের অনুপ্রেরণাহীন জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছে, যা কিনা আমাদের অবচেতন মনকে অতীতে ছাপ ফেলে যাওয়া স্মৃতি তুলে আনতে বাধ্য করছে।

সে হিসেবে লেখক ল্যান্স ওয়েলারের ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছে। কমিকসের প্রতি তার দীর্ঘদিনের ঘোর এবং টুইটারে ক্রমাগত রাজনৈতিক পোস্টে স্ক্রলিং করার যে প্রবণতা তার সম্মিলিত একটা সুরিয়াল দৃশ্য ধরা পড়েছে, যা কিনা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক যে উদ্বিগ্নতা তারই একটা ভাষ্য।

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

গবেষকদের মতে, প্যানডেমিক ড্রিম মূলত দুশ্চিন্তা, আইসোলেশন ও ঘুমের ধরনের পরিবর্তন দ্বারা চিত্রিত !

আমরা সাধারণত র্যাপিড আই মুভমেন্টে (আরইএম) ঘুম ও স্বপ্ন দেখি, যেনো তীব্র ও নেতিবাচক আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে নিশ্চিতভাবেই এ মহামারী অনেক উদ্বেগ ও মানসিক চাপ তৈরি করছে। যার কারণে মস্তিস্ক একরকম ‍জোরপূর্বক এসব দুঃস্বপ্ন দেখাতে সম্ভব হচ্ছে। স্বপ্ন দেখার কালে উদ্বেগ আমাদের মস্তিষ্ককে ভ্রমণে পাঠায়। নিউরোবায়োলজিক্যাল সংকেত ও প্রতিক্রিয়া যা স্বপ্ন তৈরি করেছে, তার সঙ্গে সাইকাডেলিক ড্রাগ দ্বারা সৃষ্ট অবস্থার সঙ্গে মিল রয়েছে। যার ফলে অপরিশোধিত আবেগী অবস্থার সৃষ্টি হয়। সেটি হয় বিশেষ করে ঘুমের আরইএম (RIM) অবস্থায় থাকার সময়। যখন মূলত আমরা স্বপ্ন দেখে থাকি। এ প্রক্রিয়াটি রাতের বেলায় ঘটলেও অনেক মানুষ সচরাচর তাদের স্বপ্ন মনে রাখতে পারে না। করোনাকালের মহামারীতে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এর কারণ অতিরিক্ত আইসোলেশন এবং দুশ্চিন্তা, যা কিনা স্বপ্নের বিষয়বস্তুকে প্রভাবিত এবং স্বপ্নদর্শীকে সেসব মনে রাখতে প্ররোচিত করে।

একজনের উদ্বিগ্নতা ও অলসতা ঘুমের গুণগত মানকে নষ্ট করে। এছাড়া বারবার জেগে ওঠা, যাকে প্যারাসমনিয়াস বলে ডাকা হয়। তা স্বপ্নকে মনে রাখার সঙ্গে যুক্ত থাকে। আগের দিনের সুপ্ত আবেগ ও স্মৃতিও স্বপ্নের বিষয়বস্তু এবং সাড়া দেয়ার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে।

আরেকটি ভিন্ন উদাহরণ দেই, ২০০৯ সালে ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়াদের নিয়ে করা একটা গবেষণা করা হয়েছিলো। সেই গবেষণায় দেখা গেছে, অনেকে ঘুমের সমস্যা ও দুঃস্বপ্ন ভূমিকম্পের উপকেন্দ্রের নৈকট্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। তারা বারবার পতিত হওয়া বা এ জাতীয় কোনো ‍ভয়ানক ‍স্বপ্ন দেখছেন। একইভাবে বর্তমান সময়ে যারা মহামারীর কাছাকাছি অবস্থান করছেন, তারাও করোনা সম্পর্কিত স্বপ্ন দেখছেন। তাদের মাঝে রয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মী, মহামারীপ্রবণ অঞ্চলে বসবাসকারী এবং যাদের পরিবারের কেউ আক্রান্ত হয়েছেন তার‍া…

প্রসঙ্গত হার্ভার্ডের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ডেইরড্রে বারেট বলেন, ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর বেঁচে যাওয়ার স্বপ্ন গবেষণা করে দুই ধরনের স্বপ্ন পাওয়া গেছে। একটা হচ্ছে ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত স্বপ্ন এবং অন্যটি ঘটনার হচ্ছে প্রতীকী অবস্থা। একইভাবে নভেল করোনাভাইরাসের সাম্প্রতিক নমুনা বলছে, কেবল স্বাস্থ্যকর্মীরা ছাড়া অন্য কেউ এ স্বপ্ন দেখছে না যে তারা শ্বাসকষ্টে ভুগছে বা ভেন্টিলেশনে আছে। যেহেতু ভাইরাসটি দেখা যায় না তাই স্বপ্নেও জম্বি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ছায়া শরীর বা দৈত্যসহ বিভিন্ন প্রতীকী রূপ নিয়ে হাজির হচ্ছে।

শেষ কথা

করোনাভাইরাস মহামারীর এ সময়টা আপনার একার জন্য খারাপ নয়। আমাদের সবার জন্যই খারাপ। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ সংকটে, শঙ্কা ও সংশয়ে দিন কাটাচ্ছে। তবুও মানুষ কিন্তু আশা ছেড়ে দিচ্ছে না। কারণ জীবন এখানেই শেষ নয়। আপনার বয়স যদি ২৫ বছর হয়ে থাকে, অন্তত আরো ৩৫ বছর বাঁচবেন। বেশি বেশি চিন্তা করা ছেড়ে দিন। এই দুর্যোগকালীন সময়টা ঘরে বসে পরিবার পরিজনদের নিয়ে কাটিয়ে দিন। এমন সুন্দর একটা অবসর বাকি জীবনে আর কোনোদিনই পাবেন না…