বোরলি রেকটোরি : ইংল্যান্ডের একটি ভূতের বাড়ি

বোরলি রেকটোরি ছিলো একটি ভিক্টোরিয়ান ম্যানশন। মালিকানায় ছিলেন সাবেক রানী অ্যানী। বাড়িটির মূল ভবন ১৮৬২ সাল উল্লেখ্য থাকলেও এর স্থাপিত সাল নিয়ে আজ অবদি তর্কবির্তকের শেষ নেই। বাড়িটি ১৯৩৯ সালে আগুনে পুড়ে মারাত্বক ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং ১৯৪৩ সালে এটি পুরোপুরি ভেঙ্গে ফেলা হয়।

১৯২০ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত ভূতুড়ে কর্মকাণ্ডের জন্য এটি ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ভূতুড়ে বাড়ি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

ইংল্যান্ডের এসাক্স এর বোরলি গ্রামে অবস্থিত এই বাড়িটি নিয়ে অনেক ভুতুড়ে গল্প প্রচলিত আছে। কিন্তু ১৯২৯ সালের দিকে এই গল্প হঠাৎ করেই ছড়িয়ে পরে যখন ডেইলি মিরর পত্রিকায় তখনকার বিখ্যাত ভৌতিক গবেষক হ্যারি প্রাইস এর এই বাড়িতে যাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। প্রাইস ভৌতিক বিষয় নিয়ে দুটি বিখ্যাত বই লেখার জন্য সেখানে গিয়েছিলেন। ১৯৫৬ এর সেপ্টেম্বরে বিবিসিতে বোরলি রেকটরি নিয়ে একটি অনুষ্ঠান প্রচার করার কথা থাকে, কিন্তু রেকটরের স্ত্রী মারিয়ানি ফয়েস্টারের আইনি পদক্ষেপের কারণে সেটি প্রচার করা সম্ভব হয়নি।

বোরলি রেকটোরির ইতিহাস খুঁজলে বেড়িয়ে আসে অদ্ভুত সব ঘটনা। ১৮৬২ সালে হেনরি দাওসন এলিস বাল বোরলি গির্জার কাছে বোরলি রেকটোরি বাড়িটি নির্মাণ করেন। একবছর পর তিনি রেকটর নাম গ্রহণ করেন ও বাড়িটিকে যাজক পল্লীতে রুপান্তর করেন এবং ১৮৪১ সালের দিকে হঠাৎ এক অগ্নিকান্ডে বাড়িটি ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে বাড়িটি গির্জার কাছে সরিয়ে আনা হয়। আর কালক্রমে এলিস বালের পরিবারের লোকজন এই বাড়িটি বড় বানাতে শুরু করেন।

ওই সময়ের অনেকেই মনে করতেন সেন্ট বেনিডিক্টের সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ন্যাসীদের এ আশ্রমটি এই এলাকায় ১৩৬২ সালে তৈরী করা হয়েছিল। কিংবদন্তীদের মতে, আশ্রমের এক যাজকের সাথে একজন সন্ন্যাসীনীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। তাদের এ সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে যাজককে সেখান থেকে অপসারন করা হয় এবং সন্ন্যাসীনীকে পাথর নিক্ষেপ করে মারা হয়।

১৯৬৩ সালে প্রমান হয় এই ঘটনার কোন ঐতিহাসিক প্রমান নেই। এটা সম্পূর্ন রেকটির পরিবারের বানোয়াট কাহিনী।

এছাড়া ধারনা করা হয়, সন্ন্যাসীনীর মতবাদ রাইডর হেগার্ড-এর উপন্যাস মনতেজুমা’স ডটার (১৮৯৩) অথবা ওয়াল্টারের বিয়োগান্তক কবিতা মারমিয়ন (১৮০৮) থেকে এসেছে। তাছাড়া সংবাদপত্রে প্রকাশের আগে পর্যন্ত এসব ঘটনা কোনো স্থানীয় পত্রিকা অথবা লিখিত কোনো দলিলে পাওয়া যায়নি অথবা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনার কথা প্রকাশ হয়নি।

বোরলি রেকটোরির মাঝামাঝি সময়ে ঘটতে থাকে অস্বাভাবিক ঘটনা !

জানা যায় যে, ১৮৬৩ সালের দিকে কিছু স্থানীয় বাসিন্দারা তার বাড়িটির চারপাশে অদ্ভুত কিছু পায়ের চিহ্ন দেখে। ২৮ জুলাই ১৯০০ সালে রেকটরের চার মেয়ে তারা এক রাতে তাদের থেকে ৪০ কদম দূরে সেই সন্ন্যাসীনীর ভূত দেখেছে এবং তারা যখন কাছে যাওয়ার চেষ্ঠা করেছিলো তখন ছায়ামূর্তিটি মিলিয়ে যায়।

আরো অনেক লোক অনেক অস্বাভাবিক ঘটনার কথা বর্ননা করেছে এই বাড়ির সমন্ধে। যেমন, কেউ কেউ নাকি দেখেছেন দুইজন মাথাহীন ঘোড়ার গাড়ি চালক টমটম নিয়ে যাচ্ছেন। একই ঘটনা পরবর্তী চল্লিশ বছর পর্যন্ত ঘটেছে।

হেনরি দাওসন এলিস বাল ১৮৯২ সালে মারা যান এবং তার পুত্র হ্যারি বাল উত্তরাধিকার সূত্রে বাড়িটি পান। ১৯২৮ সালের ৯ জুন হ্যারি বাল মৃত্যুবরন করলে রেকটোরিটি খালি হয়ে যায়। একই বছরের ২ অক্টোবর এরিক স্মিথ ও তার স্ত্রী এ বাড়িতে আসে। মিসেস স্মিথ আসার কিছুদিন পরই যখন আলমারি পরিষ্কার করছিলেন তখন তিনি বাদামী কাগজে মোড়ানো একটি যুবতী মহিলার মাথার খুলি দেখতে পান। তারপর থেকে তাদের পরিবার অস্বাভাবিক কিছু ঘটনার সম্মুখীন হন। যেমন, হঠাৎ করেই বেল বেজে উঠত, যদিও বেলের তার ছেঁড়া ছিলো, এছাড়াও রয়েছে জানালায় আলো ও অদ্ভুত পায়ের চিহ্ন।

মিসেস স্মিথ আরো বলেন তিনি ঘোড়ায় টানা গাড়িও দেখতে পেতেন। তাদের এই ঘটনা ডেইলি মিররকে জানান। তারপর মিরর তাদের রিপোর্টারকে সেখানে পাঠায়, যিনি সেখান থেকে ফিরে একটি সিরিজ রচনা করেন। ডেইলি মিরর অস্বাভাবিক ঘটনার গবেষক হ্যারি প্র‍াইসকেও সেখানে নিয়ে আসে এবং এখান থেকেই তার নাম বিখ্যাত হয়ে উঠে। হ্যারি সেখানে পৌঁছার পর নতুন ঘটনা ঘটতে থাকে যেমন, পাথর ছুঁড়ে মারা, পাত্র ছুঁড়াছুড়ি এবং আয়নাতে প্রেতাত্মাদের চিরকুট ইত্যাদি।

তারপর সেখান থেকে হ্যারি সবকিছু বাদ দিয়ে চলে আসে !

স্মিথরা ১৪ জুলাই ১৯২৯ সালে বোরলি থেকে চলে যান এবং থাকার সমস্যার কারনে এলিস বালের চাচার ছেলে লিওনেল ফয়েস্টার, তার স্ত্রী মারিয়ানি এবং পালিত কন্যা অ্যাডিলাইড ১৬ অক্টোবর ১৯৩০ সালে বাড়িটিতে উঠেন। ফয়েস্টার উঠার পরও সেখানে অনেক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে, যেগুলো তিনি প্রাইসকে লিখে পাঠান। প্রাইস বলেন, তারা বাড়িতে উঠার পর থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত বেল বেজে উঠা, জানালায় আলো ও অদ্ভুত পায়ের চিহ্নসহ আরো অনেক ঘটনা ঘটে এবং একবার তাদের মেয়ে একটি ঘরের মধ্যে আটকে যান কোনো চাবি ছাড়াই।

মারিয়ানি একবার তার স্বামীকে জানায় তাকে তার বিছানা থেকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া একবার ফয়েস্টার তার বাহুতে বড় একটি ছুঁড়ে মারা পাথর দ্বারা আঘাত পান। ডেইলি মিররের কল্যানে এই ঘটনা অনেক ভৌতিক গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষন করে এবং তারা এটাকে মারিয়ানির উপর অভিশাপ বলে মত দেন। মারিয়ানি এক বিবৃতিতে বলেন কিছু কিছু ঘটনা তার স্বামীর উপর অভিশাপ এর কারনে ঘটেছে। কিন্তু কেউ কেউ এটাকে সত্য বলে ধরে নেন।

অবশ্য পরে মারিয়ানি স্বীকার করেন তার সাথে তার বাড়ির ভাড়াটে ফ্রেক পিয়ারলেস এর যৌন সম্পর্ক ছিল এবং এটাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সে কিছু কিছু ঘটনা রটিয়েছিল।

ফয়েস্টারের স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার জন্য ১৯৩৫ সালের অক্টোবরে তারা বোরলি ছেড়ে চলে যান।

(তথ্যসুত্রঃ “The Strange Happenings at Borley Rectory – Full Account of England’s Most Famous Modern Ghost”। Fate 4 (7): 89–107)

Leave a Reply